ডলার বাজারে বিরল দরপতন, তিন বছরে টাকার অবমূল্যায়ন ৪১%

দীর্ঘ সময়ের অস্থিরতার পর দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে ডলারের দামে একপ্রকার বিরল পতন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে এ ধারা কতটা স্থায়ী হবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ৪৮ মিলিয়ন ডলার কিনে বাজারে হস্তক্ষেপ করে এই পতনের সূচনা করলেও গত তিন বছরে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েছে প্রায় ৪১ শতাংশ। ২০২২ সালে যেখানে প্রতি ডলার ছিল ৮৬ টাকা, এখন তা গড়ে ১২১ টাকা ছুঁয়েছে।
বাজার স্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ৫০ মিলিয়ন ডলারের একটি সংরক্ষণ তহবিল গঠন এবং একটি ‘মধ্যম হার’ চালু, যা ব্যাংকগুলোর আন্তঃলেনদেন হার বিশ্লেষণ করে নির্ধারিত হয়। সাম্প্রতিককালে এই মধ্যম হার কমে দাঁড়িয়েছে ১১৯ টাকা প্রতি ডলারে, যা টাকার সামান্য মূল্যবৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়।
কিন্তু খোলা বাজারে মানি এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো এখনও প্রতি ডলার বিক্রি করছে ১২৪-১২৫ টাকায়। ফলে বাজারে নজরদারি আরও কঠোর করার দাবি উঠেছে।
মানি চেঞ্জার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এম এস জামান বলেন, ব্যবসার টিকে থাকার জন্য আমাদের কিছু মার্জিন রাখতেই হয়। আমরা আগের উচ্চ দামে ডলার কিনেছি, এখন ধীরে ধীরে দাম কমিয়ে আনছি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জানান, যখন বাজারদর আমাদের নির্ধারিত ‘মধ্যম হার’ থেকে ২ শতাংশের বেশি বিচ্যুত হয়, তখন আমরা হস্তক্ষেপ করি। খুচরা বাজারের প্রভাব সামগ্রিক অর্থনীতিতে খুব বেশি নয়।
ডলারের এই দরপতনের পেছনে বেশ কিছু কারণ কাজ করছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) কর্তৃক আরোপিত বাজারভিত্তিক ডলার মূল্য নির্ধারণ ব্যবস্থা চালু হয়েছে দুই মাস আগে। এ ছাড়া রেকর্ড রেমিট্যান্স প্রবাহ, আমদানি খরচে বড় রকমের কাটছাঁট এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক ৪৮ মিলিয়ন ডলার ক্রয়—সব মিলিয়ে ডলারের চাহিদা হ্রাস পেয়েছে।
তবে এই ইতিবাচক ধারা কতটা স্থায়ী হবে তা নিয়ে অর্থনীতিবিদরা সতর্ক।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আমদানির পরিমাণ কমে যাওয়ায় বাজারে ডলারের চাপ কমেছে। তবে এতে বেশি আশাবাদী হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ এখনো সরকারি ও খোলা বাজারের দরে বড় ফারাক রয়েছে, যা খুচরা লেনদেনের আরও কঠোর মনিটরিংয়ের দাবি রাখে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রিজার্ভ বৃদ্ধি ও আমদানি সংকোচনের কারণে ডলারের ব্যবহার কমেছে। এতে অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রার দামও নিম্নমুখী হয়েছে। মানি এক্সচেঞ্জারদের মতে, সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশ ভ্রমণকারীর সংখ্যা কমে যাওয়ায় ভ্রমণজনিত ডলার চাহিদাও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের এ পরিবর্তন সাময়িক না স্থায়ী, তা নির্ভর করছে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত, বৈদেশিক আয়ের ধারাবাহিকতা এবং আইএমএফ-এর সংস্কারপন্থী শর্ত বাস্তবায়নের ওপর। এ পরিস্থিতিতে অর্থনীতির ভারসাম্য রক্ষায় কর্তৃপক্ষকে আরও বিচক্ষণ ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।