সংস্কার ছাড়া ১ হাজার বছরেও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়: আদালতে আউয়াল

মৌলিক সংস্কার ছাড়া আগামী এক হাজার বছরেও এ দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়—বিদ্যমান ব্যবস্থায় নির্বাচন কমিশনের অসহায়ত্ব তুলে ধরে আদালতকে এ কথা বলেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল।
বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) রিমান্ড শুনানিতে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমানের আদালতে তিনি এসব কথা বলেন।
এর আগে রাষ্ট্রদ্রোহ ও অন্যায় প্রভাব খাটিয়ে প্রহসনের নির্বাচন দেওয়ার অভিযোগে বুধবার রাজধানীর শেরে বাংলা থানার এক মামলায় গ্রেফতার হন সাবেক সিইসি হাবিবুল।
আজ দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটের দিকে তাকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আনা হয়। এসময় তাকে সিএমএম আদালতের হাজতখানায় রাখা হয়। মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তাকে ১০ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা ও শেরেবাংলা নগর থানার উপপরিদর্শক শামসুজ্জোহা সরকার।
শুনানিকালে দুপুর ১টা ২৫ মিনিটে হাবিবুল আউয়ালকে আদালতে তোলা হয়। এসময় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ১০ দিনের রিমান্ডে আবেদন করেন।
রিমান্ডের পক্ষে শুনানির সময় রাষ্ট্রপক্ষে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, এই আসামি ২০২২ সাল থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার আমলে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি এ দেশে কলঙ্কজনক নির্বাচন হয়। সেই ডামি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও ২/১টি দল ছাড়া আর কেউ অংশ নেয়নি। সেই নির্বাচন ছিল ডামি নির্বাচন, একতরফা, লোক দেখানো ও প্রহসনের নির্বাচন। তিনি সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাস দিতে পারেননি।
শুনানিতে ওমর ফারুক আরও বলেন—৭ জানুয়ারির নির্বাচনে তিনি গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘সারাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হচ্ছে’। এত বড় মিথ্যা বলে তিনি কীভাবে তার ফ্যামিলির সামনে মুখ দেখান। ওইদিন সকাল ৮টা থেকে ৩টা পর্যন্ত ২৭.১৫ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে জানান। তার এক ঘণ্টা পর ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে জানান। অথচ আমরা দেখেছি কেন্দ্রগুলোতে কোনো মানুষ ছিল না। কুকুর-বিড়াল কেন্দ্রে শুয়ে ছিল। ওই এক ঘণ্টা তিনি কোথায় ছিলেন জানতে চাইলে গণমাধ্যমকে বলেন, ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। কতটা হাস্যকর কথাবার্তা।
শুনানিতে সরকারি এই কৌঁসুলি আরও বলেন—আসামির বিরুদ্ধে তৎকালীন সরকারের সঙ্গে আঁতাত করার অভিযোগ রয়েছে। নির্বাচনে থোক বরাদ্দ থেকে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। সংবিধান বহির্ভূত বক্তব্য দিয়ে তিনি রাষ্ট্রদ্রোহ করেছেন। আমরা তার সর্বোচ্চ রিমান্ড প্রার্থনা করছি।
এদিকে আসামি পক্ষের আইনজীবী এমিল হাসান রুমেল তার রিমান্ড বাতিল চেয়ে বলেন—‘তার বয়স ৭০। তিনি অনেক দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছেন। আমরা যেন ফ্যাসিস্ট দমাতে গিয়ে নিজেরা ফ্যাসিস্ট না হয়ে যাই।’
এরপর আদালতের অনুমতি নিয়ে কথা বলেন সাবেক সিইসি হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেন, ‘প্রসিকিউশনের বক্তব্যের সঙ্গে আমিও একমত। নির্বাচনটি ডামি ও প্রহসনের নির্বাচন ছিল। ’
এসময় তাকে থামিয়ে বিচারক বলেন—প্রত্যেক জেলায় নির্বাচনি ইনকোয়ারি কমিটি করা হয়। যেখানে যুগ্ম জেলা জজ পদমর্যাদার একজন দায়িত্বে থাকেন। আগে যার ভাতা ছিল ২২ হাজার টাকা সেটা আপনি ৫ লাখে উন্নীত করেছেন। এতে কি জনগণের টাকা অপচয় হয়নি? এ বিষয়ে তার জানা নেই জানিয়ে বলেন—‘পাঁচ বছরের মুদ্রাস্ফীতি হিসেব করে হয়তো ভাতা বাড়ানো হয়েছিল।
এসময় তাকে থামিয়ে বিচারক বলেন—প্রত্যেক জেলায় নির্বাচনি ইনকোয়ারি কমিটি করা হয়। যেখানে যুগ্ম জেলা জজ পদমর্যাদার একজন দায়িত্বে থাকেন। আগে যার ভাতা ছিল ২২ হাজার টাকা সেটা আপনি ৫ লাখে উন্নীত করেছেন। এতে কি জনগণের টাকা অপচয় হয়নি? এ বিষয়ে তার জানা নেই জানিয়ে বলেন—‘পাঁচ বছরের মুদ্রাস্ফীতি হিসেব করে হয়তো ভাতা বাড়ানো হয়েছিল।’
এরপর বিচারক আবারও বলেন, ‘এই যে ইনকোয়ারি কমিটি করা হয়েছিল নির্বাচনের সময় কোথাও কী তারা সরেজমিনে গিয়েছিলেন? তখন আউয়াল বলেন, ‘একজন রিটার্নিং অফিসারের অধীনে ৪-৫টা সংসদীয় আসনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাকে সহযোগিতা করতে আরও ৪-৫ জন অ্যাসিস্ট্যান্ট রিটার্নিং অফিসার থাকেন। একটা নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করার জন্য ২ ভাগ দায়িত্ব কমিশনের বাকি ৯৮ ভাগ দায়িত্ব মাঠ পর্যায়ে কাজ করা অফিসারদের।’
নির্বাচনের আগে এমন অবস্থা জেনে আপনি পদত্যাগ করলেন না কেন? বিচারকের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওই অবস্থায় পদত্যাগ করা সম্ভব ছিল না। আমার এক বন্ধুও আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল পদত্যাগের কথা, আমি বলেছি তুমি যদি আগে বলতে এমন ভয়ংকর নির্বাচন হবে তাহলে আমি দায়িত্বই নিতাম না।
আউয়াল পূর্বের নির্বাচনের কথা তুলে ধরে বলেন, ‘৭২ এর সংবিধান প্রণয়নের তিন মাসের মাথায় অনুষ্ঠিত ৭৩ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৯৩টি আসন পায়। সেই নির্বাচনও সুষ্ঠু ছিল না। ক্ষমতার লোভ এমন যে শেখ মুজিবও তা সামলাতে পারেননি। ৯৬ সালে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলন করে। পরবর্তী সময়ে তারাই আবার দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে সংবিধান সংশোধন করে।
এসময় পাবলিক প্রসিকিউটর উত্তেজিত হয়ে আদালতকে বলেন, তিনি নিজেকে জাস্টিফাই করছেন। তার এসব বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ নেই। এসময় আউয়াল বলেন, জাস্টিফাই না করতে দিলে রিভলভার দিয়ে গুলি করে মেরে ফেলেন। এসময় উপস্থিত আইনজীবীরা চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করলে এজলাসে উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়।
নির্বাচন কমিশনের অসহায়ত্ব তুলে ধরে আউয়াল আরও বলেন, মৌলিক সংস্কার ছাড়া আগামী ১ হাজার বছরেও এ দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। আধ ঘণ্টার দীর্ঘ শুনানি শেষে আদালত তার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদেশ দেন।