নোয়াখালীতে শিক্ষক ও সাবেক সভাপতির চক্রান্তে
প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে মব তৈরি ও অপসারণ চেষ্টার অভিযোগ!

নোয়াখালী সদর উপজেলার খলিফার হাট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. দেলোয়ার হোসেন (৫০) এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা ও উস্কানিমূলক তথ্য শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে মব তৈরির চেষ্টা ও তাকে অপসারণের দাবি আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মদদ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সাবেক সভাপতি আবদুল্লাহ মাষ্টার, সহকারী শিক্ষক আবদুল বাতেন ও ধর্মীয় শিক্ষক মোহাম্মদ লোকমান গংদের বিরুদ্ধে।
বুধবার (২ জুলাই) বিকেলে ভুক্তভোগী ওই প্রধান শিক্ষক সহ বিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষক-কর্মচারী এবং সাবেক ও বর্তমান কমিটির কয়েকজন সদস্য সাংবাদিকদের নিকট এসব অভিযোগ জানিয়েছেন।
সরজমিনে গিয়ে জানা যায়, গত ২২ জুন সকাল সাড়ে ৯ টার দিকে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ক্লাস বর্জনের ঘোষণা দিয়ে হুট করে প্রধান শিক্ষকের কক্ষে তালা ঝুলিয়ে ব্যানার ও লিফলেট নিয়ে বিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে অবস্থান নেয় কয়েকজন শিক্ষার্থী। খবর পেয়ে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা শিক্ষার্থীদের নিভৃত করে ক্লাসে ফেরানোর চেষ্টা করলে তারা ব্যর্থ হয়। পরদিন (২৩ জুন) অন্যান্য শিক্ষক- কর্মচারী ও এমসি সদস্যদের মিটিং চলাকালীন সময়ে সহকারী শিক্ষকদের কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধরা। তারা দাবি করেন ‘প্রধান শিক্ষকের অপসারণ করতেই হবে; নয়তো তারা শ্রেণিকক্ষে ফিরবেনা।’ তবে পরিস্থিতি বেগতিক দেখে তা নিয়ন্ত্রণে বিদ্যালয়ের এডহক কমিটি তাৎক্ষনিক প্রধান শিক্ষককে সাময়িক অব্যাহতি প্রদান করেন এবং ঘটনা তদন্তে ৩ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করেন’।
শিক্ষার্থী ও অভিভাবক সূত্রে জানা যায়, ‘পাঞ্জেরী প্রকাশনীর কাছ থেকে কয়েকবছর যাবৎ সহায়ক বই পাঠ্য করে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকবৃন্দ। এর বিনিময়ে প্রকাশনীর কাছ থেকে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ও উপঢৌকন নিয়ে থাকেন তারা। বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক আবদুল বাতেন, মোহাম্মদ ইসমাঈল সহ কয়েকজন শিক্ষক সরাসরি এর সাথে জড়িত। চলতি বছর একক সিদ্ধান্তে প্রধান শিক্ষক পাঞ্জেরী পাবলিকেশন এর বই পাঠ্য না করে লেকচার ও নবদূত বই পাঠ্য করায় বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এর আগে ২০২৫ সালের শুরুর দিকে বই পাঠ্য করবে মর্মে শিক্ষকগণ পাঞ্জেরী প্রকাশনীর কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা উপঢৌকন গ্রহণ করেছে বলে জানা যায়। প্রতিশ্রুতির ১ লাখ টাকার জায়গায় ৫০ হাজার টাকা দেয়ায় প্রধান শিক্ষক ওই পাবলিকেশনের বই পাঠ্য না করে লেকচার ও নবদূত বই পাঠ্যের নির্দেশনা দেয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষক কর্মচারী বলেন, ‘বই পাঠ্য করা, ডিউটি ভাতা ও ইনক্রিমেন্ট বৃদ্ধি সহ অভ্যন্তরীণ কয়েকটা বিষয়কে পুঁজি করে শিক্ষার্থীদের উস্কানি দেওয়া হয়েছে। বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আন্দোলনে উস্কানি দিয়ে প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে। এতে বিদ্যালয়ের মান ক্ষুন্ন করা হচ্ছে ও শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ব্যাহত হচ্ছে’।
তারা শঙ্কা প্রকাশ করে আরো বলেন, ‘প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়ে প্রবেশের চেষ্টা করলে শিক্ষার্থীদের দ্বারা যেকোনো সময় মবের শিকার কিংবা লাঞ্ছিত হতে পারেন। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীরা এতোটাই আক্রমণাত্বক হয়ে উঠবে কেউ কল্পনা করেনি’ তবে ঘটনাটি সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন তারা।
বিদ্যালয়ের অভিভাবক বিডিপি শাহ আলম বলেন, ‘আমি দীর্ঘ ৩৫ বছর অত্র প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে ছিলাম। কিন্তু কখনো প্রধান শিক্ষকের অনিয়ম-দুর্নীতি চোখে পড়েনি। বিদ্যালয়ের মানোন্নয়ন এবং শৃঙ্খলা ফেরাতে খুব সক্রিয় ছিলেন তিনি। এ নিয়ে ২-৪ জন শিক্ষকের সাথে মতবিরোধ দেখা দিতে পারে। ওনার বিরুদ্ধে একটি মহল মহল ষড়যন্ত্র করছে।
বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির অভিভাবক সদস্য মো. জামাল উদ্দিন বলেন, ‘গত ৭ বছরে বিদ্যালয় থেকে যারা অনৈতিক সুবিধা নিতে পারেনি তারাই শিক্ষার্থীদের ইন্ধন দিয়েছে। অর্থ যোগান দিয়েছে। বিদ্যালয়ে ৬০ টি তালা মারা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা কোথায় পেয়েছে এসব তালা, ব্যানার ও ফেস্টুন? আমাদের কাছে শিক্ষার্থীরা কোনো অভিযোগ না করে স্কুল খোলার প্রথম দিন হুট করে প্রধান শিক্ষকের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করছে। আমরা তাদের বুঝিয়ে শুনিয়ে নিভৃত করার অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু তারা শোনেনি’।
ম্যানেজিং কমিটির এই সদস্য আরো বলেন, প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে বহিস্কারের যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে এটা অন্যায় হয়েছে। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আমাদের কিছুই করার ছিলনা। তবে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে এর আগেও নানা ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য আমাকেও ১ লক্ষ টাকার প্রলোভন দেখানো হয়েছে।
এদিকে প্রধান শিক্ষকের অনিয়ম ও দুর্নীতির সত্যতার বিষয়ে বিদ্যালয়ের এডহক কমিটির সভাপতি এডভোকেট মো. সিরাজ উদ্দিনকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘এরকম কিছুই হয়নি। তবে তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য প্রধান শিক্ষককে সাময়িক অব্যাহতি দেয়া হয়েছে এবং ঘটনা তদন্তে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কে প্রধান করে ৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্ট হাতে আসলে বিস্তারিত পরে জানানো হবে’।
জানতে চাইলে খলিফার হাট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন ‘ব্যক্তিগত হীনস্বার্থ চরিতার্থের লক্ষ্যে আমার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের মাঝে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে আন্দোলনে উস্কানি দিয়েছেন আমাদেরই কয়েকজন শিক্ষক। যার অগ্রভাগে নেতৃত্বে ছিলেন বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক আবদুল বাতেন ও সাবেক সভাপতি আবদুল্লাহ মাষ্টার, ধর্মীয় শিক্ষক মোহাম্মদ লোকমান ও কথিত সাংবাদিক রাসেদ বিল্লাহ গং।
এসময় তিনি অভিযোগ করে বলেন, বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সাবেক সভাপতি আবদুল্লাহ মাষ্টার ২০১৬ সালে কমিটির সভাপতি থাকাকালীন সময়ে ১ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা বিদ্যালয়ের ফান্ড থেকে আত্মসাৎ করেন। বিষয়টি জানতে পেরে আমি ২০২২ সালে ১ লক্ষ টাকা ও পরবর্তীতে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বাকি ৭০ হাজার টাকা উদ্ধার করতে সক্ষম হই। এছাড়াও ২০২২ সালে তৎকালীন ধর্ম মন্ত্রণালয় কর্তৃক মসজিদের জন্য বরাদ্ধকৃত ৪০ হাজার টাকা ব্যাংক হতে উত্তোলন করলে তিনি ২০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন। এনিয়ে বিভিন্ন সময় আমার সঙ্গে তার মতবিরোধ দেখা দেয়।
অন্যদিকে বিজ্ঞান বিভাগের ব্যবহারিক ক্লাস করানো সাপেক্ষে খাতা বাবত ৫০ টাকা করে নেওয়ার কথা থাকলেও আবদুল বাতেন ক্লাস না করিয়ে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের নিকট খাতা বাবত ১০০ টাকা করে নিতেন এবং তা তিনি নিজেই ভোগ করতেন। এ বিষয়ে প্রতিবাদ জানানোয় উনি অপমানিত হয়েছে মর্মে জানান। এছাড়াও ১০ম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবকের অভিযোগের প্রেক্ষিতে প্রাইভেট পড়ানো বিষয়ক ছাত্রীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ায় বিষয়ে সতর্ক করলে তিনি মনঃক্ষুণ্ণ হয়। তিনি বিভিন্ন সময় প্রভাব খাটিয়ে শিক্ষকদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন এবং শিক্ষকদের প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত করার হুমকি দেন। এছাড়াও ২০২৫ সালের এডহক কমিটিতে মনোনয়ন না পেয়ে স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি ও আ.লীগ নেতা আমার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের এসব কিছুর উস্কানি দিচ্ছেন।
তিনি আরো বলেন, ‘ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি শিক্ষকদের দাবিকৃত ইনক্রিমেন্ট ৫% এর জায়গায় ৩% ও পরীক্ষার ডিউটি ভাতা ১২০ টাকা করার সিদ্ধান্ত নেয়। যা নিয়ে শিক্ষক ও কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। অভ্যন্তরীন এসব সমস্যা সমাধানে গত ২৪ মে বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারী ম্যানেজিং কমিটি বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। এবিষয়ে কমিটি ২৩ জুন আলোচনা বসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু বন্ধের পর স্কুল খোলার ১ম দিন ২২ জুন পরিকল্পিত শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সব কিছু পাল্টে দেয় এবং শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়। এসময় তিনি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানান।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আবদুল বাতেন কে মুঠোফোনে একাধিক বার কল করলেও তিনি তা রিসিভ করেন নি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল্লাহ মাষ্টার বলেন, আমি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত নই। আমি তখন ঢাকায় ছিলাম। শুনেছি শিক্ষকদের সঙ্গেও ওনার বিরোধ চলছিল। তবে প্রধান শিক্ষক আমাকে দাতা সদস্য হিসেবে বাদ দিয়েছেন সভাপতি হিসেবেও বাদ দিয়েছেন। তিনি আমাকে অনেক অপমান করেছেন। আমি ওই বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক ও একাধিকবার সভাপতি ছিলাম। আমার সম্পর্কে খোঁজ খবর নিলে জানতে পারবেন।