সোমবার ০৭ জুলাই ২০২৫, ২৩ আষাঢ় ১৪৩২

নিজস্ব প্রতিবেদক :

প্রকাশিত: ১৩:৩২, ৭ জুলাই ২০২৫

সংগ্রাম করে যাচ্ছে রিয়েল এস্টেট, টিকে থাকার লড়াইয়ে জেসিএক্স!

সংগ্রাম করে যাচ্ছে রিয়েল এস্টেট, টিকে থাকার লড়াইয়ে জেসিএক্স!
সংগৃহীত

বাংলাদেশের রিয়েল এস্টেট খাত দীর্ঘদিন ধরেই সংকটের মুখে। তবে গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে সংকটের মাত্রা আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। মূল্যস্ফীতি, ডলারের ঘাটতি, বৈদেশিক লেনদেন জটিলতা, নির্মাণসামগ্রীর দামবৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার ফলে উচ্চবিত্ত ক্রেতাদের নির্ভরশীল এই খাতের বিক্রি প্রায় অচল। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রিমিয়াম হাউজিং নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো।

 

 

এই সংকটের ভেতরেও টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে জেসিএক্স ডেভেলপমেন্টস লিমিটেড, যারা জাপানের রিয়েল এস্টেট ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি ক্রিড গ্রুপ -এর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক এম মুহিত হাসান বলেন, এই বছরটি আমাদের জন্য ‘বেঁচে থাকার বছর' ব্যবসার মূল লক্ষ্য এখন শুধুই টিকে থাকা।

জেসিএক্স ডেভেলপমেন্টস মূলত ৪ হাজার থেকে ৯ হাজার বর্গফুটের বিলাসবহুল ফ্ল্যাট নির্মাণ করে অভিজাত শ্রেণির জন্য। এই সেগমেন্টে আগে চাহিদা থাকলেও গত এক বছরে বিক্রি প্রায় শূন্যের কোটায়। অনেক পুরোনো ক্লায়েন্ট পর্যন্ত কিস্তি দিচ্ছেন না সময়মতো। নতুন বুকিং নেই বললেই চলে।

মুহিত হাসান বলেন, আমাদের যেসব প্রকল্প চলমান, সেগুলোর কাজ চালিয়ে নিতে হচ্ছে শুধু ব্র্যান্ড ইমেজ ধরে রাখার জন্য। কিন্তু এই সময় নতুন বিক্রি না হওয়ায় রেভিনিউ আসছে না, ফলে আর্থিক চাপ বাড়ছে প্রতিনিয়ত।

বর্তমানে দেশের আবাসন বাজারে অপেক্ষাকৃত ছোট ইউনিটের চাহিদা বেশি—বিশেষ করে ১ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার বর্গফুটের অ্যাপার্টমেন্ট। কিন্তু জেসিএক্স-এর মতো বিলাসবহুল ফ্ল্যাট নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো হঠাৎ করে এই রুটে যেতে পারছে না।

আমাদের ব্যবসায়িক কাঠামো এবং প্রোডাক্ট লাইফসাইকেল একদিনে বদলানো সম্ভব নয়। ছোট ইউনিটে যেতে হলে নতুন প্ল্যানিং, নতুন ডিজাইন, নতুন অনুমোদন লাগে। এতে ১ থেকে ২ বছর সময় লেগে যাবে, বলেন মুহিত।

তবে বাজারের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে প্রতিষ্ঠানটি সম্প্রতি জলসিঁড়ি ও বসুন্ধরা এলাকায় ৫ থেকে ৬ কাঠার ছোট ছোট প্লটে কাজ শুরু করেছে। যদিও এসব প্রকল্পের অনুমোদন পেতে ৬ থেকে ১২ মাস সময় লাগে, এবং অনুমোদন ছাড়া বিক্রি করা আইনত নিষিদ্ধ।

২০১৯ সালে যাত্রা শুরু করা জেসিএক্স ডেভেলপমেন্টস এখন পর্যন্ত ১২টি প্রকল্প সফলভাবে হস্তান্তর করেছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির ইনভেন্টরিতে রয়েছে প্রায় ৬০টি প্রকল্প—এর মধ্যে ২৮টি নির্মাণাধীন, ২২টি আসন্ন এবং ১০টি ভবিষ্যতের পরিকল্পনায়।

জেসিএক্স নিজেকে একটি এলইইডি সার্টিফাইড ডেভেলপার হিসেবে পরিচয় দেয়, যারা পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই নির্মাণে বিশ্বাসী। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিটি প্রকল্পে থাকে আলাদা স্থপতি, তাই কোনো দুটি প্রোজেক্ট দেখতে একইরকম হয় না।

ক্রিড গ্রুপ জাপানের অন্যতম রিয়েল এস্টেট ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি, যারা ১০টি দেশে কাজ করছে—তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। জেসিএক্স-এর সঙ্গে তাদের অংশীদারিত্ব এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়িয়েছে। জাপানি কোম্পানির প্রকৌশলীরা প্রতিমাসেই প্রকল্প পরিদর্শনে এসে নির্মাণ মান যাচাই করে থাকেন।

কিন্তু দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় ক্রিড গ্রুপ এখন চাইছে সাশ্রয়ী আবাসনের দিকে যাওয়া। জেসিএক্স-ও ধীরে ধীরে সেই রুটে এগোচ্ছে। ইতোমধ্যে তারা ৭০০ থেকে ৮০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট ডিজাইন করছে, যা দেশের মধ্যবিত্ত ক্রেতাদের নাগালের মধ্যে থাকবে।

মুহিত হাসান বলেন, ঢাকায় যেসব মানুষ মাসে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা ভাড়া দিচ্ছেন, তাদের যদি সমপরিমাণ কিস্তিতে ফ্ল্যাট কেনার সুযোগ দেওয়া যায়, তবে সেটিই হবে সত্যিকার অর্থে সাশ্রয়ী আবাসন।

তবে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জমির দামে অসামঞ্জস্যতা। অপেক্ষাকৃত দূরের এলাকাতেও প্লটের দাম অনেক বেশি। মেট্রোরেল সংলগ্ন এলাকায় ফ্ল্যাট তৈরির পরিকল্পনা থাকলেও পর্যাপ্ত বড় প্লট খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে।

রিয়েল এস্টেট খাতে একের পর এক চ্যালেঞ্জ এসে পড়ছে। নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়েছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। ব্যাংক ঋণের সুদের হার ১১ শতাংশের ওপরে চলে গেছে। ক্রেতারা ঋণ পাচ্ছেন না, আবার অনেক পুরনো ক্রেতা কিস্তি দিতে পারছেন না। ফলে কোম্পানিগুলোও ব্যাংকের কাছে নিজেদের দায় সময়মতো পরিশোধ করতে পারছে না, নতুন করে ঋণ নেওয়াও কঠিন হয়ে পড়ছে।

এর মধ্যে কর ও রেজিস্ট্রেশন ইস্যু আরও বড় সমস্যা তৈরি করেছে। নতুন বাজেটে জমির রেজিস্ট্রেশন মূল্য বাড়ানো হলেও কর কমানো হয়েছে। এতে কিছু ক্রেতা আগেই রেজিস্ট্রেশন সেরে নিতে চাইছেন, আবার অনেকে পিছিয়ে যাচ্ছেন।

ট্যাক্স ফাইলে ‘হোয়াইট মানি’ না থাকলে কেউ ফ্ল্যাটের আসল দামে রেজিস্ট্রেশন করতে পারবেন না। রেজিস্ট্রেশন না হলে আমরাও ইউনিট হস্তান্তর করতে পারি না। ফলে ব্যবসার পুরো চেইনটাই ভেঙে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে বলেন জেসিএক্স পরিচালক।

বিলাসবহুল আবাসন খাত থেকে সাশ্রয়ী ইউনিট নির্মাণে মনোযোগী হওয়া এখন সময়ের দাবি। কিন্তু এই রূপান্তর বাস্তবায়নে সময়, নীতি সহায়তা ও ব্যাংকিং লেনদেনে সহজীকরণ প্রয়োজন।

দেশের রিয়েল এস্টেট খাতকে টিকিয়ে রাখতে হলে শুধু ট্যাক্স ছাড় বা জমির দামে ছাড় নয়, বরং প্রয়োজন নীতিগত সমর্থন ও বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা।

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ