ধুঁকছে নদী, কাঁদছে দেশ — ফরাক্কা বাঁধে অস্তিত্ব সংকটে বাংলাদেশ

ফরাক্কা বাঁধের একতরফা পানি প্রত্যাহার ও নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করার কারণে পদ্মাসহ শতাধিক নদী আজ ধ্বংসপ্রায়। ফরাক্কা চালুর পর গত পাঁচ দশকে পদ্মা নদীর পানি প্রবাহ প্রায় ৮০ শতাংশ কমেছে, নদীর প্রস্থ অর্ধেকে নেমে এসেছে। শাখা নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় উত্তরাঞ্চলে ভয়াবহ খরা, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ততা এবং সারা দেশে নদীনির্ভর কৃষির অবনতি ঘটেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানির প্রবাহ কৃত্রিমভাবে নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় বাংলাদেশের নদীগুলোর স্বাভাবিক বার্ষিক বন্যা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে বিলুপ্ত হচ্ছে বন্যার পানিতে জন্ম নেওয়া মাছ, জলজ উদ্ভিদ ও খাদ্যশস্য। উৎপাদনশীল কৃষিজমি হারাচ্ছে উর্বরতা। সুন্দরবনে ঢুকে পড়ছে লবণাক্ততা; হারিয়ে যাচ্ছে ‘সুন্দরী’ গাছ, হুমকির মুখে পড়ছে জীববৈচিত্র্য।
বর্তমান চিত্র অনুযায়ী, দেশের অন্তত ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদীর মধ্যে প্রায় সবকটিতে শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রবাহ কমে আসে বিপজ্জনক মাত্রায়। শুধুমাত্র তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যার অভাবে উত্তরাঞ্চলের লাখো মানুষ কৃষি থেকে সরে যেতে বাধ্য হচ্ছে। অপরদিকে, বর্ষা মৌসুমে হঠাৎ করে ভারতীয় বাঁধ খুলে দেওয়া হয়, যার ফলে দেখা দেয় অস্বাভাবিক বন্যা ও ফসলহানি।
এক গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৮৪ সালের তুলনায় শুষ্ক মৌসুমে রাজশাহী অংশের আয়তন কমেছে ৫০ শতাংশ। পানির গভীরতা কমেছে ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ। প্রবাহ কমেছে ২৬ দশমিক ২ শতাংশ। দক্ষিণের সুন্দরবনে মিঠাপানির সরবরাহ কমেছে ৯০ শতাংশ। ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারিতে গঙ্গায় পানি প্রবাহের পরিমাণ ছিল ৯০ হাজার ৭৩০ কিউসেক। ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারিতে পানি প্রবাহের পরিমাণ ছিল ৭৫ হাজার ৪০৯ কিউসেক। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে গঙ্গায় পানি প্রবাহ কমেছে ১৫ হাজার ৩২১ কিউসেক। যদিও সে বছর গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল পূর্ববর্তী বছর গুলোর তুলনায় ১৯ দশমিক ২ শতাংশ কম।
ফরাক্কা বাঁধকে কেন্দ্র করে ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৬ সালে। তবে চুক্তিতে কোনো বাধ্যতামূলক ‘গ্যারান্টি’ ও ‘সালিসি ক্লজ’ না থাকায় বাংলাদেশ নিয়মিতভাবে চুক্তির লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছে। তিস্তা চুক্তি ২০১১ সালে সই হওয়ার কথা থাকলেও এখনও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
ফারাক্কার ক্ষতিকর দিক নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, গঙ্গাসহ ভারত শতাধিক অভিন্ন নদীর পানি অন্যায়ভাবে প্রত্যাহারের ফলে উত্তরাঞ্চলের প্রায় দুই কোটি কৃষক সেচের পানির অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। দেশের দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলের প্রায় চার কোটি মানুষ সেচের পানির অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রজেক্টে পানি স্বল্পতার কারণে ৬৫ শতাংশ এলাকায় সেচ প্রদান দারুণভাবে ব্যহত হচ্ছে। উজান থেকে স্বাদু পানির সরবরাহ কমে যাওয়ায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ততা বেড়ে গেছে। এর ফলে জমির উর্বরতা শক্তি কমে আসছে। বরেন্দ্র অঞ্চল বিশেষ করে উচ্চ বরেন্দ্রের একশত ভাগ গভীর নলকূপ অকেজো হয়ে গেছে। ২১ শতাংশ অগভীর নলকূপ প্রায় অকার্যকর। ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের বিষাক্ত প্রভাবে উত্তর ও উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের অনেক জেলায় নলকূপের পানি খাবার অযোগ্য হয়ে পড়েছে। বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় প্রচলিত ধান উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। স্বাদু পানির অভাবে খুলনা ও সাতক্ষীরা অঞ্চলে সুন্দরবনের প্রাণবৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন, “ফরাক্কার মাধ্যমে গঙ্গার প্রবাহ কৃত্রিমভাবে সীমিত করা হলে বাংলাদেশের জন্য একটি টেকসই জলনীতি গড়ে তোলা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এ ছাড়া, গঙ্গা অববাহিকায় ভারত যে হারে নতুন বাঁধ নির্মাণ করছে, তাতে করে ভবিষ্যতে পানির ন্যায্য হিস্যার বিষয়টি আরও জটিল হবে।”
রাজধানীতে ফরাক্কা লং মার্চ দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক গণসমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন,
“ফরাক্কা বাঁধ বাংলাদেশের মানুষের জন্য মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে। এটি ছিল একটি ব্যর্থ পরীক্ষা, যার খেসারত দিচ্ছে আমাদের দেশের কোটি মানুষ। এই বাঁধ ভাঙা সম্ভব না হলেও এটিকে নিষ্ক্রিয় বা ডিকমিশন করা এখন সময়ের দাবি।”
তিনি আরও বলেন, “ভারত বহুবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, কিন্তু তা রক্ষা করেনি। আমরা বারবার দ্বিপাক্ষিকভাবে আলোচনার চেষ্টা করেছি, কিন্তু লাভ হয়নি। এখন সময় এসেছে এই পানি সংকটকে আন্তর্জাতিক ফোরামে, বিশেষ করে জাতিসংঘে তোলার।”
ড. মঈন খান আরও বলেন, “মাওলানা ভাসানী ৪৯ বছর আগে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করেছিলেন। আজও আমরা একই দাবি নিয়ে সংগ্রাম করছি। প্রশ্ন হলো—এই ৫০ বছরে আমাদের প্রাপ্তি কী?”
লংমার্চ দিবসের সাথে যুক্ত অন্যান্যরা জানান, পানির প্রবাহের অভাবে একদিকে কৃষি হুমকির মুখে, অন্যদিকে পানযোগ্য পানি সংকটে ভুগছে দেশের মানুষ। আন্তর্জাতিক নদীর ওপর একতরফা দখলদারিত্ব আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলেও মন্তব্য করেন তারা।