শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

নাজমুন নাহার

প্রকাশিত: ২৩:৪২, ৪ মার্চ ২০২৪

ক্রমবর্ধমান অগ্নি ঝুঁকি ঢাকায়, ভবন নিরাপত্তার জন্য কি করছি আমরা 

ক্রমবর্ধমান অগ্নি ঝুঁকি ঢাকায়, ভবন নিরাপত্তার জন্য কি করছি আমরা 
নাজমুন নাহার

আগুনের প্রথম দিকের ভিডিও অনেকেই শেয়ার করেছেন, ওই আগুন কি অগ্নি নির্বাপক দিয়ে নেভানোর মতো ছিল না?? কেন আগুন লাগার মতো মারাত্মক ঘটনায় প্রাণহানির পর জানা যায়, “অধিকাংশ বহুতল ভবনে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই। নেই ঠিকঠাক জরুরি নির্গমন ব্যবস্থাও”। 

২০২১ এর জুলাইতে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে একটি কারখানায় অগ্নিদুর্ঘটনায় ৫২ জন মারা যায়, ২০২২ এ নারায়ণগঞ্জের মসজিদের আগুনে ৩৪ জনের প্রাণহানি, একই বছর ইউনাইটেড হসপিটালের আগুন, গেল বছর বঙ্গবাজারের আগুন। তার আগে গুলিস্তান, ওয়ারী ও মহাখালীর সাততলা বস্তিতে এমন আগুন লাগার ঘটনা ঘটার পর জানা যায় সেখানে ঝুঁকি নিরসনের তেমন কোনো ব্যবস্থা ছিল না।

ভবন ও কারখানার ধরন ভেদে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের সেটা তদারকির কথা। সেখানে ফায়ার সার্ভিস, রাজউক, সিটি করপোরেশন, কলকারখানাঅধিদপ্তর, বিস্ফোরক অধিদপ্তর সহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকান্ড প্রশ্নবিদ্ধ। আগুন লাগার পর কিছুটা তৎপরতা দেখানোই যেন প্রথা হয়ে দাড়িয়েছে। 

জাতীয় বিল্ডিং কোড তথা ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় বলা হচ্ছে, সাততলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণের সময় ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদপ্তর, গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিভাগের ছাড়পত্র নেয়া বাধ্যতামূলক। এর চেয়ে উঁচু ভবনের ক্ষেত্রে এসবের সঙ্গে ফায়ার ডিটেক্টর, স্মোক ডিটেক্টর, উচ্চগতির পানি স্প্রে সিস্টেম ও কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন সিস্টেম থাকাও বাধ্যতামূলক। এসব নিয়ম আদৌ কি মানেন ভবন মালিকরা? 

আইনে বলা আছে, যদি কেউ জাতীয় বিল্ডিং কোডের অংশবিশেষও সঠিকভাবে মানতে ব্যর্থ হন, তাহলে তিনি কমপক্ষে সাত বছরের জেল অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এমন শাস্তি কেউ কি ভোগ করেছে?? 

অগ্নিকাণ্ড কাঠামোগত ত্রুটির বহিঃপ্রকাশ। অগ্নিঝুঁকিতে থাকা ভবন মালিক ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নামমাত্র ব্যবস্থা নেয়া হয়। 

হাউজ বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউশনের মাধ্যমে সব পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ নিয়ে পূর্ণাঙ্গ বিল্ডিং কোড প্রণীত হয়, যা মাঠ পর্যায়ে প্রয়োগের জন্য ২০০৬ সালে আইনগত ভিত্তি পায়। বিল্ডিং কোড প্রয়োগ কি হয়েছে?  

মানবাধিবার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ সংবাদ মাধ্যমে বলেছেন, প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের পর একাধিক সংস্থা তদন্ত কমিটি গঠন করে। শুরু হয় নানা রকম আলোচনা। আগুনের সূত্রপাত, ক্ষয়ক্ষতির হিসাব ও বেশ কিছু সুপারিশ সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পৌঁছায়। কিন্তু মাস ঘুরে বছর যায়, সেই সুপারিশ আর বাস্তবায়ন হয় না। সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতায় একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মামলা হয়নি। আবার দু’ একটি ক্ষেত্রে মামলা হলেও সাজার কোনো নজির নেই! অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়ীদের চিহ্নিত করা হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

একটা সময় রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকাটি কেবল আবাসিক এলাকা হিসেবেই পরিচিত ছিল।  অফিস, হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠার সুবাদে সেখানে গড়ে উঠতে শুরু করে একের পর এক রেস্টুরেন্ট। গত কয়েক বছরে ‘রেস্টুরেন্ট জোন’ হিসেবে খ্যাতি পেয়ে গেছে ধানমন্ডি। সাত মসজিদ রোডের পাশে এমন অনেক ভবন আছে, যেসব ভবনে ১০ থেকে ১৫টি পর্যন্ত রেস্টুরেন্ট আছে। 

এসব ভবনের প্রকাশ্যে ‘সার্টিফিকেট’ প্রদর্শন করা আছে কি-না; প্রবেশদ্বার তিন মিটারের কম না হওয়া; পর্যাপ্ত সিঁড়ি ও অ্যালার্ম সিস্টেম থাকা; জরুরি বহির্গমন পথ আছে কি না; আগুন লাগলে ‘এক্সিট সাইন’ জ্বলার সিস্টেম আছে কি না; ফায়ার এক্সটিংগুইশার বা অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র আছে কি না; মিশ্র ব্যবহারের ভবনে না যাওয়া; ডাক্ট লাইন ও ক্যাবল হোল সিল করা; স্প্রিংকলার সিস্টেম আছে কি না এবং ভবনের ডিজাইন ও উদ্দেশ্য পরিবর্তন করা হয়েছে কি না, সব কিছুই নিয়ে আছে ধোয়াশা। 

শংকর থেকে শুরু করে জিগাতলা পর্যন্ত আপনি সড়কের যে পাশেই তাকান না কেন, সুউচ্চ বিল্ডিংগুলো বাহারি আলোকসজ্জায় আপনাকে আকৃষ্ট করবে। প্রতিটি ভবনই কাঁচে ঘেরা।  নেই কোন বাতাস নির্গমন ব্যবস্থাও। 

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালে সারা দেশে মোট ২৭ হাজার ৬২৪টি আগুনের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় কয়েকশ’ মানুষ নিহত ও আহত হয়েছেন। 

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের তথ্য অনুযায়ী, আগুন লাগার পর একটা মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য ভবনে মূলত দুইটা জিনিস থাকা দরকার। একটি হচ্ছে পর্যাপ্ত সিঁড়ি এবং অন্যটি হচ্ছে অ্যালার্ম সিস্টেম। আর কিছুর দরকার নেই। কোনো আবাসিক ভবন যদি ছয় তলার চেয়ে বেশি হয়, তাহলে আইন অনুযায়ী সেখানে চলাচলের জন্য দুটি সিঁড়ি থাকতে হবে। তবে যেগুলো বাণিজ্যিক ভবন বা কারখানা, সেখানে সিঁড়ির সংখ্যা আরও বেশি হবে। 

ফায়ার সার্ভিস বলছে— ঢাকায় আবাসিক, বাণিজ্যিক, বিপণিবিতান, মিডিয়া হাউজ, হাসপাতাল-ক্লিনিকসহ অগ্নিঝুঁকিতে থাকা ভবনের পরিসংখ্যান আছে। তবে আলাদাভাবে অগ্নিঝুঁকিতে থাকা রেস্টুরেন্টের কোনো তালিকা তারা করেননি। 

তবে, ঢাকা শহরে প্রায় পাঁচ হাজার রেস্টুরেন্ট ও খাবারের হোটেল রয়েছে। এর ৯৬ শতাংশই নিয়ম না মেনে কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে বিপজ্জনক পরিবেশে চলছে। এছাড়া আবাসিকের অনুমতি নিয়ে বাণিজ্যিক ভবন করা হয়েছে বহু জায়গায়। যেখানে অবৈধভাবে চালানো হচ্ছে রেস্তোরাঁসহ নানা বাণিজ্যিক কারবার।  বাড়িভাড়া বাবদ লাখ লাখ টাকা আয়, কিন্তু তাতেও সন্তুষ্ট নন ভবন মালিকরা। ছাদ দখল করে তৈরি চিলেকোঠায় কখনও আবাসিক, আবার কখনও তৈরি করা হচ্ছে রুফ টপ রেস্টুরেন্ট।

২০১০ সালে প্রথম ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। পরে ২০১৬ সালে তালিকাটি হালনাগাদ করে রাজউক। তাদের তথ্য অনুযায়ী— রাজধানীতে অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা ৩২১টি। এর মধ্যে বিধিবিধান লঙ্ঘন করে নির্মিত ভবন রয়েছে ৫ হাজার। অতি ঝুঁকিপূর্ণ ৩২১টি ভবনের বেশিরভাগই রয়েছে পুরান ঢাকায়। তাদের হিসেবেও নেই রেস্তোরাঁ বা রেস্টুরেন্টের সংখ্যা। 

তবে আজকাল, বাণিজ্যিক ভবনগুলোতে দেখা যায় সিঁড়িতেও জিনিসপত্র রাখা হয়, অনেক ভবনে তো সিলিন্ডারও রাখা হয়। যা নিয়ে এখনই ভাবতে হবে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি সুস্থ আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আর না হলে থামবে না আপনজন হারানোর বেদনা। বয়ে বেড়াতে হবে নিকটজন হারানোর দগদগে স্মৃতি।

লেখক: সোস্যাল এক্টিভিস্ট ও লেখক।

সম্পর্কিত বিষয়: