আবাসন খাত সংকটে: মূল্যবৃদ্ধি,
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বৈশ্বিক যুদ্ধাবস্থায় দিশেহারা ব্যবসায়ীরা!

নির্মাণসামগ্রীর লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি, উচ্চ সুদের ঋণ, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বৈশ্বিক যুদ্ধাবস্থার জোড়া চাপে চরম অনিশ্চয়তা ও উৎকণ্ঠায় পড়েছে দেশের আবাসন খাত। এমন পরিস্থিতিকে ‘অতিসংবেদনশীল’ বলে আখ্যায়িত করেছেন আবাসন খাতের একজন অভিজ্ঞ উদ্যোক্তা, দ্য ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সাবেক পরিচালক এবং জেসিএক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইকবাল হোসেন চৌধুরী।
তিনি মনে করেন, চলমান সংকট নিরসনে পরিকল্পিত ব্যবস্থা না নেওয়া হলে এই খাত শুধু বিপর্যস্ত হবে না, বরং দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
ইকবাল হোসেন বলেন, “আবাসন খাতের বর্তমান অবস্থায় আমরা শঙ্কিত। একদিকে ব্যাংকের সুদের হার এখন ১৫ শতাংশের ওপরে, অন্যদিকে রড, সিমেন্ট, ইট, বালুর মতো কাঁচামালের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। এই ব্যয় আমাদের বাধ্য করছে ফ্ল্যাটের দাম বাড়াতে। ফলে মধ্যবিত্ত ও চাকরিজীবী শ্রেণির মানুষের আগ্রহ কমে যাচ্ছে।”
তিনি বলেন, আগে যেসব গ্রাহক ফ্ল্যাট বা প্লট কেনায় উৎসাহ দেখাতেন, তারাও এখন নিরুৎসাহিত। গ্রাহকের সংখ্যা ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। অনেকে বুকিং বাতিল করে দিচ্ছেন, আবার অনেকে কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছেন।
রাজউকের ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) বাস্তবায়নের অস্পষ্টতা, অনুমোদনের জটিলতা এবং সময়ক্ষেপণও এই খাতকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। “একটা ভবনের প্ল্যান পাস করাতে দুই বছর লেগে যায়,” বলেন ইকবাল হোসেন।
তিনি বলেন, “পরিবেশ, ফায়ার, ডিটিসিএ এবং রাজউকের একাধিক শাখা থেকে অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। এতে শুধু বিনিয়োগ আটকে থাকে না, বরং বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও নিরুৎসাহিত হন।”
তিনি মনে করেন, ওয়ানস্টপ সার্ভিস চালু করে এই প্রক্রিয়া ৩ থেকে ৬ মাসে সম্পন্ন করা সম্ভব, যাতে আবাসন খাতের ওপর চাপ কমে।
আবাসন খাতে বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহও ব্যাহত হচ্ছে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো সহজে টাকা ফেরত নিতে পারে না।
“বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বলেন, বাংলাদেশে টাকা ঢোকানো সহজ, কিন্তু ফেরত নেওয়া কঠিন। এর সমাধানে নীতিমালায় কিছু পরিবর্তন জরুরি।”
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আন্তর্জাতিক যুদ্ধাবস্থা দুটোই আবাসন খাতকে ধাক্কা দিচ্ছে।
ইকবাল হোসেন বলেন, “শুধু দেশে নয়, বৈশ্বিক যুদ্ধ পরিস্থিতি যেমন ইউক্রেন-রাশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতের প্রভাবও পড়ছে। একদিকে সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে, অন্যদিকে বিনিয়োগকারীরা অস্থির হয়ে পড়ছেন। ফলে আবাসন খাতে এক ধরনের অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে।” অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ থাকা দরকার বলেও মত দেন ইকবাল হোসেন চৌধুরী।
তিনি বলেন, যখন এই অর্থ ব্যবহারের সুযোগ থাকে, তখন অনেকে আবাসন খাতে বিনিয়োগ করেন। এতে একদিকে অর্থ পাচার কমে, অন্যদিকে খাতে পুঁজি আসে। কিন্তু এবারের বাজেটে করের হার বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যা নিরুৎসাহিত করেছে।”
তিনি মনে করেন, অন্তত আগামী এক-দুই বছর এই সুযোগ বহাল রাখা দরকার।
ইকবাল হোসেন চৌধুরী বলেন, “সরকার যদি দেশীয় পণ্যের উৎপাদন বাড়াতে সহায়তা করে এবং আমদানি পণ্যের ওপর অযৌক্তিক ভ্যাট ও শুল্ক কমায়, তাহলে নির্মাণসামগ্রীর দাম কিছুটা কমবে।”
তিনি আরও বলেন, “রাজউক, ফায়ার, পরিবেশ অধিদপ্তর—সব সংস্থাকে এক ছাতার নিচে এনে ওয়ানস্টপ সার্ভিস চালু করা হলে দ্রুত পরিকল্পনা পাস ও অনুমোদন সম্ভব হবে।”
আবাসন খাতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক জড়িত। এই খাত ধসে পড়লে ব্যাপক হারে বেকারত্ব বাড়বে, যা অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকি হবে।
তিনি বলেন, “সুদের হার, রাজনৈতিক অস্থিরতা, ড্যাপ বাস্তবায়নে দেরি, কাঁচামালের দাম—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ভয়াবহ। অনেক প্রতিষ্ঠান টিকতে পারবে না। সরকারের উচিত এখনই হস্তক্ষেপ করা।” টিকে থাকার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছেন আবাসন ব্যবসায়ীরা।
ইকবাল হোসেন বলেন “আমরা নির্মাণ ব্যয় ধরে অনেক ফ্ল্যাট বিক্রি করছি। ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলে সুদের হার কিছুটা কমানোর চেষ্টা করছি, যাতে ক্রেতারা উপকৃত হন। তবে দীর্ঘমেয়াদে এই পথে টিকে থাকা সম্ভব না। সরকারকে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
আবাসন খাতের উদ্যোক্তাদের স্পষ্ট বার্তা, এখনই পরিকল্পিত সিদ্ধান্ত না নিলে এই খাত বড় ধরনের বিপর্যয়ে পড়বে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “জিডিপিতে এই খাতের অবদান বিবেচনায় নিয়ে বাস্তবভিত্তিক নীতি, যৌক্তিক ভ্যাট কাঠামো, দ্রুত অনুমোদন প্রক্রিয়া এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে।”
ইকবাল হোসেন আরও বলেন, “বিশ্বের অনেক দেশেই আবাসন খাতে সরকারের দৃষ্টি থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে এই খাতকে এখনো প্রাধান্য দেওয়া হয় না। এটি অব্যাহত থাকলে উন্নয়ন ব্যাহত হবে।”