বুধবার ২১ মে ২০২৫, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

নাজমুন নাহার :

প্রকাশিত: ১০:২৮, ২১ মে ২০২৫

সোলার বিদ্যুতেই বদলাচ্ছে বাংলাদেশের জ্বালানি

সোলার বিদ্যুতেই বদলাচ্ছে বাংলাদেশের জ্বালানি
সংগৃহীত

প্রায় দুই দশক আগে বাংলাদেশের সোলার বিদ্যুৎ যাত্রা শুরু হলেও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা ও উচ্চ খরচের কারণে এই সম্ভাবনাময় খাতটি দীর্ঘদিন পিছিয়ে ছিল। তবে বিগত তিন-চার বছরে দৃশ্যপট দ্রুত বদলেছে। সরকারের নেট মিটারিং চালু, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে এখন দেশের বিভিন্ন বাসাবাড়ি, কলকারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়িক ভবনে সোলার প্যানেল স্থাপন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

নেট মিটারিং এমন একটি ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে সৌর প্যানেল মালিকরা নিজেদের ব্যবহারের পর অতিরিক্ত উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে পাঠাতে পারেন। ভবনের বিদ্যুৎ ব্যবহারের চেয়ে যদি উৎপাদন বেশি হয়, তবে সেই অতিরিক্ত অংশ সরাসরি জাতীয় গ্রিডে বিক্রি করে অর্থ আয় করা সম্ভব হয়।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্র জানায়, একজন ব্যবহারকারী মাস শেষে অন্তত ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ বিল সাশ্রয় করতে পারেন। যদি অতিরিক্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়, তাহলে ভবিষ্যতের বিল থেকে সেটি সমন্বয় হয়ে যায় অথবা ব্যবহারকারী আর্থিকভাবে লাভবান হন।

এ পদ্ধতিকে আরো বেশি জনপ্রিয় করতে, বর্তমান এর নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে সরকার, জানিয়েছে জ্বালানী মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। নতুন নীতিমালায় পূর্বের ৭০ শতাংশ সীমাবদ্ধতা তুলে দেওয়া হবে এবং শতভাগ উৎপাদিত বিদ্যুৎ গ্রিডে সরবরাহের সুযোগ রাখা হবে। একইসঙ্গে একসময় কেবল তিন-ফেজ বা ৩৩ কেভি সংযোগধারীদের জন্য সীমিত ছিল এই সুবিধা, তবে নতুন নীতিমালায় সাধারণ ২২০-ভোল্ট একক-ফেজ সংযোগধারীদের জন্যও এটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

বুয়েটের অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম বলেন, “নেট মিটারিং হচ্ছে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এটি শুধু প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারই নয়, বরং জনগণকে জ্বালানি উৎপাদনে অংশগ্রহণকারী করে তুলছে।”

প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ফলে বর্তমানে সৌর প্যানেল স্থাপনের খরচ অনেক কমেছে, এবং ইউটিউবসহ বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে সোলার বিদ্যুতের উপকারিতা দেখে অনেকেই এগিয়ে আসছেন।

ঢাকার এক ব্যবহারকারী বলেন, “প্রথমে ইউটিউবে দেখে আগ্রহী হই। এখন আর কোনো বিদ্যুৎ বিল দিতে হয় না, বরং অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিক্রি করে আয় করি। পরিবেশবান্ধব বলেও মনটা ভালো থাকে।”

বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৫-৬ ঘণ্টা কার্যকর সূর্যালোক পাওয়া যায়। গবেষণা বলছে, শুধুমাত্র শহরের ছাদগুলো কাজে লাগিয়েই ২০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। এই ব্যবস্থায় বছরে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হতে পারে।

বাংলাদেশ সোলার অ্যান্ড রিনিউএবল এনার্জি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. হাসান রেজা বলেন, “ছাদভিত্তিক সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ হলে জাতীয় গ্রিডের উপর চাপ কমবে, বিদ্যুৎ ঘাটতি কমবে এবং জীবাশ্ম জ্বালানির আমদানি নির্ভরতা হ্রাস পাবে।”

যদিও প্রযুক্তির উন্নয়ন ও নীতিগত সংস্কারে গতি এসেছে, তবুও কিছু চ্যালেঞ্জ এখনো রয়েছে। যেমন—দক্ষ জনবল ঘাটতি, ব্যাটারি ও ইনভার্টারের উচ্চ মূল্য, এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি। তবু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নেট মিটারিংয়ের সম্প্রসারণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি এ খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসবে।

সাধারণত একটি সোলার প্যানেলের আয়ুষ্কাল ২০ থেকে ২৫ বছর হয়ে থাকে, অন্যদিকে ব্যাটারি, প্যানেল ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি দুই থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়। শুরুতে এর স্থাপন খরচ বেশি হলেও দীর্ঘমেয়াদে এটি অনেক বেশি সাশ্রয়ী। সাধারণ গ্রিডের বিদ্যুতের মতই সোলার দিয়ে সব ধরণের বিদ্যুৎচালিত যন্ত্র ব্যবহার করা সম্ভব।

সৌর বিদ্যুৎ এখন আর শুধু পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির প্রতিশ্রুতি নয়, বরং অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত। নেট মিটারিং চালুর ফলে নাগরিকরা এখন বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী থেকে উৎপাদক ও উপার্জনকারীতে রূপ নিচ্ছেন। সরকার, উদ্যোক্তা ও সাধারণ মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ হয়তো আগামী এক দশকে দক্ষিণ এশিয়ার নবায়নযোগ্য জ্বালানির রোল মডেল হয়ে উঠবে।