উত্তরায় বিমান দুর্ঘটনা : প্রশ্নের মুখে F-7 যুদ্ধবিমানের নিরাপত্তা

ঢাকার উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজের উপর বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে অন্তত ২০ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটেছে। দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও অন্তত ১৭১ জন, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী। এই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় গোটা দেশজুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া, আর বিমান বাহিনীর ব্যবহৃত যুদ্ধবিমান F-7 BGI-এর নিরাপত্তা নিয়ে দেখা দিয়েছে নতুন করে বিতর্ক।
চীনা চেংদু কর্পোরেশন নির্মিত F-7 BGI মূলত রাশিয়ার তৈরি MiG-21 এর একটি লাইসেন্সপ্রাপ্ত ও উন্নত সংস্করণ। ১৯৭০ সালে রাশিয়ার কারিগরি সহায়তায় চীন এই বিমানটির উৎপাদন শুরু করে।
দীর্ঘ চার দশক ধরে বিশ্বজুড়ে ব্যবহৃত এই বিমানটির উৎপাদন ২০১৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। F-7 কে তৃতীয় প্রজন্মের ফাইটার জেট হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। ওয়ার থান্ডার ও অ্যারোস্পেস গ্লোবাল নিউজ (AGN)-এর তথ্য অনুযায়ী, এটি বিশ্বব্যাপী বিমান প্রতিরক্ষা, বহুমুখী সামরিক অভিযান এবং পাইলট প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে নতুন প্রজন্মের ফাইটার জেটের তুলনায় F-7-এর দুর্ঘটনার হার তুলনামূলকভাবে বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর পুরানো এয়ারফ্রেম নকশা, সীমিত সুরক্ষা বৈশিষ্ট্য, এবং আধুনিক ফ্লাইট নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অনুপস্থিতি এই দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ২০২২ সালে এই F-7 BGI বিমানটি সংগ্রহ করে, যেটি বিশেষভাবে বাংলাদেশের প্রয়োজন অনুযায়ী কাস্টমাইজ করা হয়েছিল। তবে একটি আধুনিক যুদ্ধবিমান সংযোজন না হওয়া পর্যন্ত এটিকে একটি “অস্থায়ী সমাধান” হিসেবেই দেখা হচ্ছিল।
বিধ্বস্ত হওয়া বিমানটি সকাল ১টা ৬ মিনিটে ঢাকা থেকে উড্ডয়ন করে এবং মাত্র ১২ মিনিট পরই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে জনবহুল এলাকা উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরের মাইলস্টোন স্কুলের একটি শ্রেণিকক্ষে পতিত হয়। পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম (সাগর) শেষ মুহূর্তে বিমানটিকে জনবসতি এড়িয়ে অন্যত্র নেওয়ার চেষ্টা করলেও সফল হতে পারেননি। বিস্ফোরণে আশপাশের ভবনের জানালাও ভেঙে পড়ে। প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, কারিগরি ত্রুটিই এই দুর্ঘটনার মূল কারণ হতে পারে।
এই দুর্ঘটনা একা নয়—F-7 মডেলের বিমান নিয়ে অতীতেও একাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। ২০০৮ সালের এপ্রিলে টাঙ্গাইলের ঘাটাইলের পাহাড়িপাড়া গ্রামে একটি F-7 বিধ্বস্ত হয়ে স্কোয়াড্রন লিডার মোর্শেদ হাসান নিহত হন। ২০১৫ সালের জুনে চট্টগ্রামের পতেঙ্গার উপকূলে একটি F-7MB বিধ্বস্ত হয়, এবং পাইলট তাহমিদ রুম্মান নিখোঁজ হন। ২০১৮ সালের নভেম্বরে টাঙ্গাইলের মধুপুরে আরেকটি F-7BG বিধ্বস্ত হয়ে প্রাণ হারান পাইলট আরিফ আহমেদ। আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পাকিস্তানে ২০১৫ ও ২০২০ সালে একই ধরনের জেটে তিনজন পাইলট নিহত হন। ২০২২ সালের মে মাসে ইরানের ইসফাহানে একটি F-7 বিধ্বস্ত হয়ে আরও দুইজন পাইলট নিহত হন।
এই দুর্ঘটনার পরপরই বাংলাদেশ সরকার ২২ জুলাইকে জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করেছে। ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্তে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং নিহতদের প্রতি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে শোক জানানো হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, একই মডেলের বিমান নিয়ে ঘন ঘন দুর্ঘটনা ঘটলে তা কেবল প্রযুক্তিগত বিষয় নয়, বরং নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণে অসতর্কতা ও পরিকল্পনার অভাবের প্রতিফলন। আধুনিক যুদ্ধ পরিস্থিতি মোকাবেলায় নতুন প্রজন্মের বিমানের সংযোজন এখন সময়ের দাবি। F-7 BGI-এর স্থলে নতুন, নিরাপদ এবং কার্যকর যুদ্ধবিমান সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তা আজকের এই ট্র্যাজেডি আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।
এই দুর্ঘটনা শুধু একটি বিমান দুর্ঘটনা নয়—এটি একটি রাষ্ট্রের সামরিক, কারিগরি ও মানবিক প্রস্তুতির বাস্তবতা সামনে এনে দিয়েছে। আমাদের শিশুরা যেন আর কখনো এমন ভয়াবহ ঘটনার শিকার না হয়, সেটিই এখন জাতি হিসেবে আমাদের অঙ্গীকার হওয়া উচিত।