শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

হাসান শান্তনু

প্রকাশিত: ২২:০৮, ১৯ মার্চ ২০২৪

ইফতারের থালায় কি থাকবে, এটা সরকার নির্ধারণ করবে?

ইফতারের থালায় কি থাকবে, এটা সরকার নির্ধারণ করবে?
হাসান শান্তনু

সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির সুফিবাদ, সুফি ইসলাম, বা সুফিদের নিয়ে গবেষণামূলক যেসব কাজ করেছেন, তাঁর সমকালের দেশীয় কেউ তা করেননি। পৃথিবীখ্যাত কয়েক সুফিকে নিয়ে তাঁর নির্মিত তথ্যচিত্র নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক মানের। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, 'প্রগতিশীল' আওয়ামী লীগ, দলটির সরকারের আমলে এসব তথ্যচিত্র আলাদা কদর, প্রচারণা পাবে। সমাজে ইসলামের সহনশীল রূপের বিস্তার ঘটাতে সুফিবাদের প্রচারণায় তাঁর তথ্যচিত্র, গবেষণা কাজে লাগাবে সরকারি দল, সরকার। দুঃখজনক হচ্ছে, তা ঘটেনি। উগ্র ওহাবিদের বিস্তার যতো ঘটছে, সুফিবাদ ততো কোনঠাসা হচ্ছে। ইসলামের নামে কট্টর ওহাবিবাদের যে বিস্তার ঘটেছে গত এক-দেড় দশকের মধ্যে, এতে কোনো না কোনোভাবে 'ধর্মনিরপেক্ষ' আওয়ামী লীগ, সরকারের মদদ আছে। মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ ছেড়ে গেলে তাঁর স্থানে আওয়ামী লীগ বসায় মওলানা তর্কবাগীশকে।

 

প্রয়াত নির্মল সেন, বদরুদ্দীন উমরের মতো বামনেতারা তখন অভিযোগ করেন, 'আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষ দল নয়। এক মওলানার শূন্যতা পূরণে আরেক মওলানাকে দলে ভিড়িয়ে প্যান ইসলামবাদীদের সমর্থন আদায় করে।' আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতিশীলরা তখন বিষয়টির ব্যাখ্যা করেন, 'মওলানা তর্কবাগীশকে দলে ঠাঁই দেয়া হয়েছে সহনশীল ইসলাম সম্পর্কে মানুষকে দীক্ষা দেয়ার জন্যে। যেন এ ধর্মকে ঘিরে সমাজে মৌলবাদ না ছড়ায়।' মওলানা তর্কবাগীশকে দলে নেয়ার বিষয়ে যে ব্যাখ্যা দেন দলটির প্রতি সহানুভূতিশীলরা, সেই অবস্থানে আজকের আওয়ামী লীগ নেই। ধর্মান্ধ ওহাবিজমে বিশ্বাসী হেফাজতের মতো উগ্র সংগঠনগুলোকে আওয়ামী লীগ ঠাঁই দিয়েছে বগলের তলে। ইসলাম প্রচারে আওয়ামী লীগের ভূমিকা নিয়ে দলটি টাকাপয়সা খরচ করে তথ্যচিত্র বানায়। শীর্ষ নেতাদের বক্তব্যজুড়ে প্রায় সময় থাকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের প্রতি তাদের 'প্রীতি'।

 

আওয়ামী লীগের, সরকারের প্রায় অনুষ্ঠান শুরু হয় শুধু কোরআন তেলাওয়াত দিয়ে। একসময় দলটির, এদের সরকারের অনুষ্ঠান শুরু হতো কোরআন তেলাওয়াতের পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠের মধ্য দিয়ে। 'আওয়ামী লীগের' একটা অংশ গত দেড় দশকে ক্রমেই 'আওয়ামি মুসলিম লিগের' পথে হেঁটেছে। এদের সরকারও 'সেক্যুলার' আদর্শচর্চার বদলে 'প্যান ইসলামিক' চরিত্র ধারণ করতে চেয়েছে। প্রগতিশীল দল, সরকার একটা বিশেষ ধর্মের 'মডেল' উপাসনালয় বানায় না, ইসলামকে 'অবমাননার' অভিযোগে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের গ্রেপ্তার করে না, শুধু রাষ্ট্রধর্মের প্রতি তাদের 'বিশেষ আসক্তির' কথা রাষ্ট্রীয় কোষাগারের পয়সা খরচ করে প্রচার করে না। ধর্মনিরপেক্ষ দল, সরকার মূলত কোনো ধর্ম নিয়েই রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে কথা বলে না। মানুষ কীভাবে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালন করবে, আদৌ পালন করবে কী না, সেসব নিয়েও চুপ থাকে।

 

এবারের রোজা শুরুর আগে একমন্ত্রী ইফতারের থালায় 'খেজুরের পরিবর্তে বরই' রাখার পরামর্শ দেন। রোজা রাখা ব্যক্তি তার সাধ্যমতো পণ্য ইফতারের থালায় রাখবেন। এখানে কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সরকার বা রাষ্ট্রের নির্ধারণ করে দেয়ার কিছু নেই। ইসলামের প্রচারক মুহাম্মদ (সা.) ইফতারে খেজুর খেতেন বলে উল্লেখ আছে সর্বোচ্চ হাদিসগ্রন্থ বুখারিতে। কোনো ধর্মের প্রচারক, প্রবর্তক যা খেতেন, বা খেতেন না, সেগুলো সেই ধর্মাবলম্বীদের কাছে অনুসরণীয়। এ বিচারে মুসলমানদের কাছে ইফতারে খেজুরের অবশ্যই আবেগগত মর্যাদা আছে (খেজুর একেবারে অত্যাবশ্যক নয়। দেশের রোজা রাখা ব্যক্তিদের মধ্যে গরিব শ্রেণির ইফতারের থালায় তা থাকেও না)। মন্ত্রিসভার কোনো সদস্যের দায়িত্ব সেই খেজুরের বদলে বরই খাওয়ার মতো বালখিল্যের পরামর্শ দেয়া নয়। তার দায়িত্ব হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি ঘটলে নিত্যপণ্যের দাম যৌক্তিক পর্যায়ে আনতে নিজের মন্ত্রণালয়ের কর্তব্য পালনের পাশাপাশি সরকারকে পরামর্শ দেয়া। অর্থনীতি চলে 'চাহিদা ও সরবরাহ' নীতিতে। দাম বাড়ানোর চক্র (সিন্ডিকেট) 'মরিচের বদলে মিষ্টি কুমড়া খাওয়ার পরামর্শ তত্ত্ব' অর্থনীতির কাজে লাগাতে গেলে আপদ বাড়বে।

 

এবার রোজা শুরু হওয়ার আগে-পরে অনেক পণ্যের যে দাম ছিলো, সেই তুলনায় আজ মঙ্গলবার সেসব পণ্যের দাম বেশ কম ছিলো। এটা সম্ভব হয়েছে, সরকারি অভিযান, তদারকির কারণে। এমন উদ্যোগ অব্যাহত থাকলে পণ্যের দাম আরো কমবে। পশ্চিমা দুনিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বহু বিবিতে আসক্ত বাদশা, শেখসহ দেশীয় রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে উপেক্ষা করে যে সরকার যুদ্ধাপরাধী, পঁচাত্তরের ঘাতকদের ফাঁসির রায় কার্যকর করতে পারে, সেই সরকার আন্তরিকভাবে চাইলে এ দেশে পণ্যের দাম বাড়ানোর চক্র বলতে কিছু থাকবে না, এটা দুধের গ্যাঁদা শিশুকেও বিশ্বাস করানো সম্ভব।

-সাংবাদিক ও লেখক

সম্পর্কিত বিষয়: