বৃহস্পতিবার ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২০ ভাদ্র ১৪৩২

নাজমুন নাহার

প্রকাশিত: ২১:৫০, ১ সেপ্টেম্বর ২০২৫

চিঠি দিবসে জেগে উঠুক পুরনো দিনের স্মৃতি

চিঠি দিবসে জেগে উঠুক পুরনো দিনের স্মৃতি
সংগৃহীত

আজ চিঠি দিবস। আজকের এই দিনে আমরা ফিরে তাকাই সেই দিনগুলোর দিকে, যখন এক টুকরো কাগজ, কিছু লেখা আর একটুখানি সময়ের ব্যবধান হয়ে উঠত মানুষের আন্তরিকতার মূল প্রকাশ। সেই চিঠির ভেতরে থাকত অজস্র অনাবিল কথা—যা মুখে বলা যেত না। থাকত এক অপরিসীম স্নেহ, ভালোবাসা এবং আশা, যা একসময় সমাজের প্রতিটি কোণায় ছড়িয়ে পড়ত।

আজকের বাস্তবতায় আমরা এমন এক দেশের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনীতির ধীরগতি, পরিবেশগত সংকট—এসবই আমাদের চারপাশে। কিন্তু একইসঙ্গে আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, আত্মবিশ্বাস এবং জনগণের লুকানো শক্তি আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করে।

চিঠি কেবল ব্যক্তিগত আবেগের বাহন নয়, ইতিহাসেরও সাক্ষী। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে প্রবাসী সরকার থেকে পাঠানো চিঠি, কিংবা মুক্তিকামী মানুষের মধ্যে আদান-প্রদানের চিঠি হয়ে উঠেছিল সাহস ও অনুপ্রেরণার উৎস। বিদেশে থাকা শ্রমজীবী মানুষের পাঠানো চিঠি আর সঙ্গে থাকা মানি অর্ডার কত পরিবারকে টিকিয়ে রেখেছিল, তা ইতিহাসের পাতায় আজও জ্বলজ্বল করছে।

ডাক বিভাগের ভূমিকাও এখানে অনন্য। একসময়কার ডাকপিয়ন কেবল চিঠি পৌঁছে দিতেন না, তিনি হয়ে উঠতেন গ্রামের খবরের বাহক, সম্পর্কের সেতুবন্ধন। তাঁর সাইকেলের ঘণ্টার শব্দ কারও হৃদয়ে কাঁপন ধরাতো, আবার কারও মনে ভরিয়ে দিত আনন্দ। এই ডাকপিয়ন সংস্কৃতি হয়তো ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তার আবেগ আজও মানুষের ভেতরে টিকে আছে।

ডিজিটাল যুগে তাৎক্ষণিক বার্তা পাঠানো সহজ হলেও, সেই অপেক্ষার উত্তেজনা, হাতে লেখা অক্ষরের ঘ্রাণ, কিংবা কাগজে লুকানো মনের ছোঁয়া আর নেই। চিঠি দিবসে তাই প্রশ্ন জাগে: প্রযুক্তি যতই এগোক, মানবিক আবেগ প্রকাশে কি আমরা কিছু হারাচ্ছি না?

তবে এই ঐতিহ্যকে আবারও জীবন্ত করা সম্ভব। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের চিঠি লেখায় উৎসাহিত করা হলে তাদের প্রকাশভঙ্গি ও সৃজনশীলতা বাড়বে। পরিবারে বা কর্মস্থলে বিশেষ দিনে হাতে লেখা একটি চিঠি মানুষের মধ্যে আন্তরিকতা ফিরিয়ে আনতে পারে। এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ভার্চুয়াল চিঠি দিবস আয়োজন করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে আগ্রহ জাগানো যেতে পারে।

আন্তর্জাতিকভাবে অনেক দেশে এখনো চিঠি দিবসকে কেন্দ্র করে প্রদর্শনী, প্রতিযোগিতা কিংবা ঐতিহাসিক চিঠির পুনর্মুদ্রণ করা হয়। বাংলাদেশেও ডাক বিভাগ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে এ ধরনের আয়োজন সম্ভব হলে নতুন প্রজন্ম ঐতিহ্য ও ইতিহাসের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত হতে পারবে।

অতএব, আজকের চিঠি দিবস কেবল একটি স্মরণ দিবস নয়, এটি পুরনো ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণ এবং ভবিষ্যতের প্রতি নতুন আশার প্রতীক। চিঠির অক্ষরগুলো হয়ে উঠতে পারে সেই আশার চিহ্ন, যা আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপে অনুপ্রেরণা যোগাবে। আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ, একতা, ভালোবাসা এবং বিশ্বাস—সবকিছুই লুকিয়ে আছে সেই চিঠির ভেতরে। 

ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ: প্রায় সবদেশ সংরক্ষণ করে রেখেছে বিখ্যাত চিঠি

বিভিন্ন দেশ তাদের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক চিঠি সংরক্ষণ করে, কারণ এগুলো শুধু কাগজের টুকরো নয়, বরং সেসময়ের রাজনীতি, সংস্কৃতি, এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কের অনন্য দলিল। এগুলোকে প্রায়শই “সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য” হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

কিছু উল্লেখযোগ্য উদাহরণ নিচে দেওয়া হলো:

১. যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস বিশ্বের বৃহত্তম লাইব্রেরিগুলোর মধ্যে একটি, যেখানে অসংখ্য ঐতিহাসিক চিঠির সংগ্রহ রয়েছে। সেখানে আব্রাহাম লিংকনের চিঠি 'বিক্সবি লেটার' খুবই বিখ্যাত। গৃহযুদ্ধের সময় একজন মাকে সান্ত্বনা দিতে তিনি এই চিঠিটি লিখেছিলেন, যার ছেলে যুদ্ধে নিহত হয়েছিল। তাছাড়া আরো রয়েছে টমাস জেফারসনের হাজারো চিঠি।

২. যুক্তরাজ্যের দ্য ন্যাশনাল আর্কাইভস এবং ব্রিটিশ লাইব্রেরি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ব্রিটিশ ইতিহাসের নথি সংরক্ষণ করে আসছে। সেখানে রানী প্রথম এলিজাবেথের চিঠি: মেরিকে লেখা তার চিঠিগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আরো আছে, উইনস্টন চার্চিলের চিঠি যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন তার কৌশল এমনকি তার স্ত্রীকে লেখা প্রেমের চিঠিও সংরক্ষিত আছে।

৩. ভারতের ন্যাশনাল আর্কাইভস অফ ইন্ডিয়াতে রয়েছে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং ঔপনিবেশিক ইতিহাস-এর অমূল্য দলিলপত্র রয়েছে। সেখানে মহাত্মা গান্ধীর চিঠি 'একটি অহিংস আন্দোলন কিভাবে চালাতে হয়' বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
পাশাপাশি, জওহরলাল নেহেরু এবং অন্যান্য নেতাদের চিঠি রয়েছে।

৪. ফ্রান্সের জাতীয় আর্কাইভসে, ফরাসি বিপ্লব থেকে নেপোলিয়নের যুগ—ইতিহাসের নাটকীয় সব অধ্যায়ের সাক্ষী হিসেবে অসংখ্য চিঠি রয়েছে।

নেপোলিয়ন বোনাপার্টের তার স্ত্রী জোসেফিনকে লেখা তার প্রেমের চিঠিগুলো খুবই বিখ্যাত। পাশাপাশি, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তিনি যে সব চিঠি লিখতেন, সেগুলোও সংরক্ষিত আছে।

৫. বাংলাদেশের জাতীয় গ্রন্থাগার এবং বাংলাদেশ জাতীয় আর্কাইভসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন অনেক চিঠিপত্র সংরক্ষিত রয়েছে।
কেন এই চিঠিগুলো সংরক্ষণ করা হয়?
বইয়ের বর্ণনার চেয়ে সরাসরি সেই সময়ে লেখা চিঠি ইতিহাসের বিশ্বস্ত উৎস। পাশাপাশি এগুলো একটি জাতির পরিচয়ের অংশ। ইতিহাসবিদ, লেখক এবং শিক্ষার্থীরা এই চিঠি থেকে অতীত সম্পর্কে গভীরভাবে জানতে পারেন। জাতীয় নেতাদের চিন্তাভাবনা ও সংগ্রাম নতুন প্রজন্মকে প্রেরণা দেয়।

কিভাবে এলো এই দিবস

আন্তর্জাতিক চিঠি দিবসের সূচনা ২০১৪ সালে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক রিচার্ড সিম্পকিনের হাত ধরে। নব্বই দশকের শেষ দিকে তিনি নিজ দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উদ্দেশে চিঠি লিখে পাঠাতেন। যদিও অনেক সময় তিনি কোনো উত্তর পেতেন না, কিন্তু যখন পেতেন, তখন তার আনন্দ ছিল অসীম। সেই আনন্দই তাকে অনুপ্রাণিত করত এগিয়ে যেতে।
চিঠির সেই হারিয়ে যাওয়া সৌন্দর্যকে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যেই তিনি ১ সেপ্টেম্বরকে ‘বিশ্ব চিঠি দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেন। এরপর থেকেই প্রতি বছর এই দিনে মানুষকে চিঠি লেখায় উৎসাহিত করা হয়, বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের হাতে কলমে চিঠি লেখার অভ্যাস গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়।