মঙ্গলবার ০৩ জুন ২০২৫, ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

নাজমুন নাহার :

প্রকাশিত: ১০:০১, ১ জুন ২০২৫

কাঁচা চামড়ার দাম বাড়ানোর উদ্যোগে, ট্যানারি খাতের উদ্বেগ

কাঁচা চামড়ার দাম বাড়ানোর উদ্যোগে, ট্যানারি খাতের উদ্বেগ
সংগৃহীত

ঈদুল আজহার সময় দেশের কাঁচা চামড়ার বাজারে অস্বাভাবিক মূল্য পতন এবং ট্যানারি মালিকদের বিরুদ্ধে মূল্য নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ দীর্ঘদিনের।

বহু বছর ধরে ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে আসছেন, ঈদের সময় সমন্বিতভাবে খুব কম দামে কোরবানির পশুর চামড়া কিনে নেয়া হয়, যার ফলে সাধারণ বিক্রেতা ও মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হন।

এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকার ৩৫ বছর পর কাঁচা ও ওয়েট-ব্লু চামড়া রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করেছে। এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী তিন মাস, অর্থাৎ ২৫ আগস্ট পর্যন্ত ব্যবসায়ীরা এলসি (Letter of Credit) খুলে এসব চামড়া রপ্তানি করতে পারবেন। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে রপ্তানি সহায়ক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে।

দেশের চামড়া খাত রপ্তানি আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্ব বহন করছে। তৈরি পোশাকের পর এ খাতকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রপ্তানিমুখী খাত হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর পারফরম্যান্স নিম্নমুখী।

২০২২-২৩ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি আয় হয় ৯৬১.৪৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। এক সময় এ খাতের রপ্তানি ১.১৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল (যেমন, FY15)। ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের মে পর্যন্ত সময়ে রপ্তানি আয় ১৪.১৭% হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৯৬১.৪৯ মিলিয়ন ডলারে। এর মধ্যে ফিনিশড লেদার রপ্তানিতে কিছুটা প্রবৃদ্ধি (৯.৭১%) থাকলেও চামড়াজাত জুতার রপ্তানি প্রায় ২৬% কমে গেছে।

তবে সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী (জুলাই ২০২৪-মার্চ ২০২৫), সামগ্রিকভাবে খাতটি কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছে। এ সময়ে রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছে ৮৫২.০১ মিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৯.৮৯% বেশি।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চামড়াজাত পণ্যেরজু তার রপ্তানি বৃদ্ধিই এর মূল কারণ।

তবে, দেশের বেশিরভাগ ট্যানারির Leather Working Group (LWG) সনদ না থাকায় আন্তর্জাতিক উচ্চমূল্যের বাজারে প্রবেশ সম্ভব হচ্ছে না। এই সনদের অভাবে বাংলাদেশ বছরে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় হারাচ্ছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে।

কাঁচা চামড়া রপ্তানির নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্তে খুশি হয়েছেন চামড়া ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মনজুর হাসান বলেন, “এটি একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। কাঁচা ও ওয়েট-ব্লু চামড়া রপ্তানি করতে পারলে বাজারে চাহিদা বাড়বে, আর বিক্রেতারা ন্যায্য দাম পাবে।”

তিনি আরও জানান, ওয়েট-ব্লু চামড়া ২ থেকে আড়াই বছর পর্যন্ত সংরক্ষণযোগ্য হওয়ায় গত বছর জমে থাকা চামড়াও এবার রপ্তানির সুযোগ পাবে। “যার ইচ্ছা সে রপ্তানিতে অংশ নিতে পারবে। দেশে পড়ে থাকা চামড়া এবার কাজে লাগবে,” বলেন তিনি।

অন্যদিকে, ট্যানারি মালিকেরা এই সিদ্ধান্তকে হুমকি হিসেবে দেখছেন। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও সালমা ট্যানারির মালিক মো. সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, “আমরা এই দেশে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে কাঁচা চামড়া প্রসেস করে ভ্যালু অ্যাডেড পণ্য তৈরি করি। এখন কাঁচা চামড়া রপ্তানি হলে আমাদের কারখানাগুলোর কাঁচামালের ঘাটতি হবে।”

তিনি আরও বলেন, “ভ্যালু অ্যাড না করে ওয়েট-ব্লু চামড়া রপ্তানি করলে ভালো দাম পাওয়া যাবে না। তাহলে এত টাকা বিনিয়োগ করে আমরা এই শিল্প গড়লাম কেন? এ রপ্তানি শিল্পের জন্য ধ্বংসাত্মক।”

সাখাওয়াত উল্লাহ মনে করেন, কাঁচা চামড়া রপ্তানির নিষেধাজ্ঞা ১৯৯০ সাল থেকে এই কারণেই আরোপ ছিল – যাতে দেশের ট্যানারি শিল্প বিকশিত হয় এবং দেশে ভ্যালু অ্যাডেড প্রক্রিয়া ঘটে।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এ সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণরূপে একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা, যার মূল উদ্দেশ্য চামড়ার বাজারে সঠিক মূল্য নিশ্চিত করা। ঈদের সময় সরকারি মূল্যে চামড়া কেনা হয়, কিন্তু বাস্তবে বাজারে সেটি মানা হয় না। রপ্তানির সুযোগ থাকলে ব্যবসায়ীরা বিদেশে বিক্রির সুযোগ পাবে, ফলে দেশীয় বাজারেও প্রতিযোগিতা বাড়বে এবং দাম বাড়বে বলে মনে করছে সরকার।

তবে ব্যবসায়ীরা সরকারের কাছে আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানির সহায়তা, বাজার সংযোগ এবং প্রয়োজনীয় নীতিগত সমর্থন চেয়েছেন, যাতে এই সুযোগ বাস্তবায়নে তারা সফল হতে পারেন।

সম্পর্কিত বিষয়: