নোয়াখালী
জুলাই অভ্যুত্থানে সম্মুখ সারির যোদ্ধা উজ্জলের স্মৃতিকথা

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকার উৎখাতের আন্দোলনে নোয়াখালীর রাজপথে থেকে দূর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার এক সম্মুখ সারির যোদ্ধা সাইফুল ইসলাম উজ্জ্বল। তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল নোয়াখালী জেলার একজন অকুতোভয় সৈনিক।
সাইফুল ইসলাম উজ্জ্বল বলেন, নোয়াখালী জেলা শহর মাইজদী থেকে সোনাপুর জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত সমন্বয়কের সাথে যোগাযোগ করে প্রতিদিন ছাত্রজনতা নিয়ে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে সকল কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতাম। পুলিশের হয়রানির পাশ কাটিয়ে অদম্য সাহসিকতা নিয়ে আন্দোলনে ছিলেন সক্রিয় থাকার কারণে বাড়িতে ২-৩ দিন পর পর পুলিশের অভিযান-তল্লাশি অব্যাহত রাখতো। বাড়িতে না পেলে টার্গেট করা হতো প্রোগ্রামে। কয়েকজন ডিবি সিভিল ড্রেসে প্রোগ্রাম এর আশেপাশে ফলো করতো। আমি প্রোগ্রামে ভিতরে থাকতাম সবসময়। আমাকে, সিনিয়র কয়েকজন বড়ভাই ফিসফিস করে বলতো উজ্জল তোমাকে প্রশাসন টার্গেট করছে। তুমি প্রোগ্রাম থেকে যাওয়ার সময় সাবধানে যাবে। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে একটু কৌশল অবলম্বন করতাম।
তখন আন্দোলনে গেলে ২ টা জামা সাথে করে নিয়ে যেতাম। পতাকা তো আছেই। যে জামা পরিধান করে আমি আন্দোলন সংগ্রাম ও মিছিল করতাম। প্রোগ্রাম শেষে সে জামা পরিবর্তন করে অন্য জামা পরিধান করতাম এবং সবসময় মাস্ক অথবা হেলমেট রাখতাম। একেকদিন একেকটা যায়গায় থাকতাম। প্রতিটি আন্দোলনে পোলাপান নিয়ে প্রোগ্রাম সফল করতে কমবেশী অর্থ জোগান দেওয়া লাগতো তবুও সৈরাচার আওয়ামী লীগ হঠাৎ ছিলাম নির্ভিক।
৩ আগষ্ট চূড়ান্ত তান্ডব শুরু। নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের পার্টি অফিস জ্বালিয়ে দেওয়ার পর মাইজদী শহরের পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত। জানতে পারি জেলা ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী আমার গায়ে পরা শার্ট টার্গেট করে আমাকে খোজাখুজি করছে। সাথে প্রশাসন তো আছেই। সেই রাত কিছুক্ষণ পরপর আমার শরীর কেঁপে উঠতে থাকে আতংকে। মাঝেমাঝে সুযোগ করে বাড়িতে ফোন করে যোগাযোগ করতাম আর বলতাম মা আমাদের জন্য দোয়া করো।
পরদিন ৪ আগষ্ট সকাল ৭টার মধ্যে আমি মাইজদী শহর এসে হাজির। আমাদের সাথে আওয়ামীলীগের নেতাদের সাথে কিছুক্ষণ ধাওয়া- পাল্টা ধাওয়া চলছে। সকাল ৮ টার দিকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মাইজদী শহর থেকে আউটে চলে গেছে। আমরা দুপুর ২টা পযন্ত শহরে অবস্থান করি। হঠাৎ নিউজ আসলো আওয়ামী লীগের লোকজন সোনাপুরের উপর দিয়ে কোন ছাত্র- ছাত্রী এবং যাঁরা আন্দোলনে আসতে চাচ্ছে তাদের বাধা দিচ্ছে এবং হামলা করছে। এমন নিউজ শুনার পর আমরা মাইজদী প্রোগ্রাম শেষ করে সোনাপুর জিরো পয়েন্ট উদ্দেশ্য রওনা দিলাম মিছিলে তখন প্রায় ১ হাজারের বেশি বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ছিল। আমি স্লোগান দিতাম এবং মিছিলের সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিতাম। হঠাৎ আমরা দত্তেরহাট বাজার শেষ তেলের পাম্প এগিয়ে আসলে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী এলোপাতাড়ি গুলি চালায় এবং রেললাইনের ইট পাথর নিক্ষেপ করছে। আমরা ও কিছুটা পাল্টা আক্রমণ করি। আমরা গুলির সামনে ছিলাম হয়তো সেই দিন আমার সাথে আমার কোন ভাই বন্ধু মারা যেতো। তারপরেও মিছিলটিতে থাকা কয়েকজন ছেলে মেয়ের উপর হামলার ঘটনা ঘটে। দত্তের হাট বাজার থেকে আউটে গিয়ে কল দিয়ে বাইক নিয়ে আসে। আমার এক বন্ধু আমাকে বাইকে করে নিয়ে দিয়ে আসে ফরাজি বাজারের আশেপাশে। আমি আমার বন্ধুর শশুর বাড়িতে লুকিয়ে থাকতাম।
হঠাৎ খবর আসলো ৬ তারিখ নয়, ৫ তারিখে ঢাকা যাওয়ার ঘোষণা। ‘লংমার্চ টু গণভবন’। আমি সারা রাত আল্লাহকে স্বরণ করে অপেক্ষায় থাকতাম কখন ফজরের আজান হবে। আমি আজান শুনার পর পরেই অজু করে নামাজ পড়ে রওনা দিলাম। বাড়ি থেকে বাজারে আসলাম বাজারে এসে দেখি একটা গাড়িও নেই। আমি আর দাঁড়িয়ে না থেকে হেঁটে হেঁটে রওনা দিলাম। হঠাৎ সোনাপুর কালিতারা বাজার পর্যন্ত আসতেই পিছনে দেখি একটা সিএনজি। আমি গাড়ির ড্রাইভারকে সিগনাল দিলে উনি দাঁড়ায়। বলে কই যাবেন?
আমি উনাকে বললাম আমিতো যুদ্ধে যাচ্ছি ড্রাইভার হেঁসে দিয়ে বলে আসলে আপনি কই যাবেন? আমি বললাম আপনি আমাকে মাইজদী নামিয়ে দিয়ে আসুন। উনি বলে মাইজদী গন্ডগোল চলে ঐদিকে যাবো না। পরে আমি উনাকে রিকুয়েষ্ট করে বললাম তাহলে আপনি আমাকে কবিরহাট সড়ক হাতেল্লা পুল অথবা আমার এলাকা ওয়াপদার পোল বিসিকের সামনে নামিয়ে দিলে হবে। আমি আপনাকে ভাড়া বাড়িয়ে দিবো।
সিএনজি ড্রাইভার হেঁসে দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। লুকিং গ্লাসে একটু পরপর শুধু আমার দিকে তাকায় আর আমাকে বলে, আরে ভাই আপনি কোন টেনশন করবেন না, আমি আছি। এ-ই কথা শেষ করে কালা মিয়ার পুল বাজারে কিছু লীগের পোলাপান আমাদের গাড়ি সিএনজি সিগনাল দিয়ে দাঁড়ায় করায়।
ছেলে গুলো আমাকে সার্চ করে বলে তুমি কোথায় যা-ও? আমি বলছি বাড়িতে যাচ্ছি। ওরা বলে আমি নাকি মাইজদী যাচ্ছি। আমি বলছি আমি যাবো অশ্বদিয়া। আমি তো মাইজদী যাচ্ছি না আমাদের তর্কের মধ্যে সিএনজি ড্রাইভার বলে ও আমার খালাতো ভাই। তোরা কোন ঝামেলা করিসনা। আমরা মাইজদী যাচ্ছি না আমরা অন্য দিকে যাচ্ছি। এই কথা বলার পর সিএনজি ছেড়ে দিলো। ড্রাইভার আমাকে বলে আপনাকে ওরা সাদা শার্ট পড়া পায়ে কেডস, আমার স্টাইল দেখে ওরা মনে করছে আপনিও ছাত্র আন্দোলনে যাচ্ছেন। আসলেই তাই ড্রাইভার আমাকে আমার এলাকায় নামিয়ে দেয় আর আমার জন্য দোয়া করে দিলো।
আমি আমার এলাকার কয়েকজনকে নিয়ে দত্তের হাট, তারপর সোনাপুর জিরো পয়েন্ট অনেক ক্ষণ অবস্থান করার পর শত-শত পোলাপান নিয়ে মাইজদী উদ্দেশ্য রওনা দিলাম। মাইজদী শহর জুড়ে শুধু স্লোগান আর স্লোগান। যতবেলা হচ্ছে ততই বাড়ি ঘর থেকে এবং কাজ রেখে সবাই মাইজদীর দিকে রওনা হচ্ছে। দুপুর ২ টা পর ঘোষণা করলো নতুন সূর্য উঠছে।
আলহামদুলিল্লাহ। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই কখনো থেমে থাকেনি। ৫ তারিখ শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া পর্যন্ত আমি মনে করি আমার ভুমিকা ছিলো চোখে পড়ার মতো (আল্লাহ কে স্বাক্ষী রেখে বলছি) বিজয়ের হাসি, বিজয়ের কান্না, স্মৃতি গুলো ইতিহাস হয়ে থাকবে।
আমার সবসময় ত্যাগ, সাহস ও নেতৃত্বের উপর অটল বিশ্বাস ছিলো। এদেশে নতুন সূর্য উদিত হওয়ার পিঁছনে যদি মনে করেন আমি উজ্জলের নুন্যতম অবদান ছিলো তবে প্লীজ কিছু চাইনা একটু বড় মনের পরিচয় বহন করে স্বীকারোক্তি দিয়েন। অবশ্যই আমৃত্যু গর্ব করে বুক ফুলিয়ে বলব যে ‘আমিও জুলাই গনঅভ্যুত্থানের একজন সৈনিক ছিলাম’। এদেশ থেকে স্বৈরাচার হাসিনার পতনে আমার ও ভুমিকা ছিলো আলহামদুলিল্লাহ। এটা আমার সবসময় গর্বের জায়গা হয়ে থাকবে।
সুস্থতা কামনা করি জুলাই গনঅভ্যুত্থানে আহতদের এবং নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।আর শুকরিয়া আল্লাহর দরবারে হয়তো তাদের তলিকায় আমি উজ্জল ও থাকতাম।