গ্যাস সংকটে ধুঁকছে জনজীবন ও শিল্প খাত: অর্থনীতি পড়ছে গভীর অনিশ্চয়

রান্না করার গ্যাস নেই, সিএনজি স্টেশনে দীর্ঘ লাইন, শিল্পকারখানায় বন্ধ উৎপাদন—দেশজুড়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে গ্যাস সংকট।
রাজধানী থেকে শুরু করে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, সাভার, চট্টগ্রামসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ শিল্পাঞ্চলগুলোয় এই সংকট ঘিরে জনজীবনে নেমে এসেছে দুর্ভোগের ছায়া। শিল্প খাতে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রপ্তানি, বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়ছে, আর অর্থনীতিতে সৃষ্টি হয়েছে গভীর অনিশ্চয়তা।
চুলা জ্বলে না, কিন্তু বিল ঠিকই আসে ঢাকার জিগাতলার বাসিন্দা নওশীন ইয়াসমিন প্রতিদিন সকালেই রান্নার জন্য গ্যাসের অপেক্ষায় থাকেন। কিন্তু অধিকাংশ দিনই তার চুলা জ্বলে না। "রান্না না করে অফিস যাওয়া লাগে।" আর একই ভবনের অন্যান্য পরিবারের বাচ্চাদেরও সকালে না খেয়ে স্কুলে পাঠাতে হয়। অথচ গ্যাস বিল মাসে মাসে ঠিকই আসছে বলে জানান উক্ত ভবনের বাসিন্দারা।
রাজধানীর কাঁঠালবাগান, কলাবাগান, ধানমন্ডি, রামপুরা, মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকাতেই একই চিত্র। অনেকে বাধ্য হয়ে সিলিন্ডার অথবা বৈদ্যুতিক হটপ্লেট ব্যবহার করছেন, যা খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে দ্বিগুণ।
তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষও সংকটের বিষয়টি স্বীকার করেছে। প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী কাজী মো. সাইদুল হাসান বলেন, “যেসব গ্রাহক গ্যাস পাচ্ছেন না, তারা চাইলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে পারেন।”
তার এই বক্তব্যে ক্ষোভে প্রকাশ করেছেন অনেক ভোক্তা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই মন্তব্য নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে।
জানা যায়, পেট্রোবাংলা ও তিতাস সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৩৮০ কোটি ঘনফুট, অথচ সরবরাহ হচ্ছে মাত্র ২৭২ কোটি ঘনফুট। দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৮৮ কোটি ঘনফুটে। অবশিষ্ট গ্যাস আসছে এলএনজি আমদানির মাধ্যমে। কিন্তু ডলার সংকট এবং অবকাঠামো জটিলতায় আমদানিও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, “আমাদের দেশে গ্যাসের বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও অনুসন্ধান ও উত্তোলনে সরকার পর্যাপ্ত উদ্যোগ নেয়নি। এখন এলএনজির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি, যা টেকসই নয়।”
বাসা-বাড়ির পাশাপাশি, সবচেয়ে বড় ক্ষতির মুখে পড়েছে দেশের তৈরি পোশাক শিল্প। এই খাত থেকেই আসে রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশ। গ্যাস না থাকায় কারখানাগুলোতে দিনে উৎপাদন বন্ধ থাকছে। মাঝরাতে কিছুটা গ্যাস চাপ পেলেও শ্রমিকদের অতিরিক্ত মজুরি দিয়ে কাজ করাতে হচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, আশুলিয়া ও সাভারে অনেক কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। গত আট মাসে শুধুমাত্র নারায়ণগঞ্জেই ১৯টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, চাকরি হারিয়েছেন ১৫৭৩ শ্রমিক।
বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, “আমাদের ১২৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস দরকার শিল্প চালাতে, অথচ তা মিলছে না। এতে আমরা রপ্তানি আদেশ রাখতে পারছি না। বিদেশি ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।”
নোমান গ্রুপ, ইবনে সিনা, চৈতি ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কসহ দেশের বড় বড় কারখানাগুলোতে উৎপাদন প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।
খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পেও গ্যাস সংকটের প্রভাব তীব্র। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী বলেন, “গ্যাস না থাকায় অনেক ফ্যাক্টরিতে ডিজেল চালাতে হচ্ছে। এতে খরচ বেড়েছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ।”
মুন্নু সিরামিক ও আরএকে সিরামিকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, গাজীপুর ও ময়মনসিংহের কারখানায় স্বাভাবিক উৎপাদন হচ্ছে না। রহিমা ইস্পাত ও বিএসআরএম-এর মতো ইস্পাত কারখানাগুলোতেও উৎপাদন সীমিত করা হয়েছে।
রহিমা ইস্পাত মিলের চেয়ারম্যান সাইফুর রহমান বলেন, “রাতে গ্যাস একটু পাওয়া যায়, তাই রাতেই ফ্যাক্টরি চালাতে হচ্ছে। এতে বিদ্যুৎ খরচ ও শ্রমিক মজুরি বাড়ছে। ব্যবসা চালানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে।”
নতুন শিল্প স্থাপনের জন্য গ্যাস সংযোগ দেওয়া হচ্ছে না। পুরনো কারখানার চাহিদা বাড়লেও সংযোগ বৃদ্ধি করা হচ্ছে না। ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও আগ্রহ হারাচ্ছেন। পেট্রোবাংলা জানায়, বর্তমানে গ্যাস সংযোগের অপেক্ষায় আছে ১০০০টির বেশি আবেদন।
তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজ বলেন, “জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ছাড়া আমরা নতুন সংযোগ বা লোড বাড়াতে পারি না।”
বেকার হয়ে পড়ছেন হাজারো শ্রমিক। অনেক পরিবারে নেমেছে চরম আর্থিক সংকট।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদে এই সংকট নিরসনের জন্য প্রয়োজন দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধানে বিনিয়োগ বাড়ানো। একাধিক সম্ভাবনাময় গ্যাসক্ষেত্র (যেমন সুন্দরবন উপকূল, সমুদ্র এলাকা) এখনও অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে।
অন্যদিকে সরকার এলএনজি আমদানিতে নির্ভরতা বাড়াচ্ছে। কিন্তু এতে খরচ বাড়ছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ বাড়ছে।