সোমবার ০৪ আগস্ট ২০২৫, ১৯ শ্রাবণ ১৪৩২

নিজস্ব প্রতিবেদক :

প্রকাশিত: ২১:২৬, ৩ আগস্ট ২০২৫

এনসিপির ‘নতুন বাংলাদেশের’ ২৪ দফা ইশতেহার ঘোষণা

এনসিপির ‘নতুন বাংলাদেশের’ ২৪ দফা ইশতেহার ঘোষণা
সংগৃহীত

‘নতুন বাংলাদেশের’ ২৪ দফা ইশতেহার ঘোষণা করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।

 

রবিবার (৩ আগস্ট) সন্ধ্যায় শহীদ মিনারে এনসিপি আয়োজিত এক সমাবেশে এ ইশতেহার ঘোষণা করেন দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।

 

তিনি বলেন, আমাদের দলের জন্ম, এনসিপির জন্ম, আমাদের সকল শ্রম, আপনাদের স্বপ্নের নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য। আপনাদের অভিযোগ-অনুযোগ, প্রত্যাশা আমাদের ভাবনাকে করেছে গভীর, আমাদের লক্ষ্যকে করেছে সমৃদ্ধ। তাই ঠিক একবছর পর  আমরা আবার শহীদ মিনারে আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে একটি নতুন বাংলাদেশের, আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিকের ২৪ দফা ইশতেহার ঘোষণা করছি।

 

এনসিপির ২৪ দফা ইশতেহারে যা আছে–

১। নতুন সংবিধান ও সেকেন্ড রিপাবলিক উপনিবেশবিরোধী লড়াই, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও জুলাই গণঅভ্যুত্থানে জনগণের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে আমরা বহু ভাষা ও সংস্কৃতি ও জাতির নতুন বাংলাদেশ তৈরি করবো। পুরাতনকে ঝেড়ে ফেলে, আমাদের রাষ্ট্রের নতুন যাত্রায়, আমাদের প্রথম অঙ্গীকারই হচ্ছে গণপরিষদের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান। জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা পূরণে, আমাদের এই নতুন সংবিধান, একনায়কতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদী কাঠামোর বিলোপ করে একটি বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও জনকল্যাণমুখী সেকেন্ড রিপাবলিক গঠন করবে। আমাদের নতুন রাষ্ট্র ব্যক্তির জীবন, জীবিকা, মর্যাদা ও অধিকার সংরক্ষণ করবে। এই নতুন সংবিধান আমাদের রাষ্ট্রের আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার সুনির্দিষ্ট বিভাজন ও ভারসাম্য নিশ্চিত করবে। আমরা জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করবো।

 

এনসিপির ২৪ দফা ইশতেহারে যা আছে–

১। নতুন সংবিধান ও সেকেন্ড রিপাবলিক উপনিবেশবিরোধী লড়াই, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও জুলাই গণঅভ্যুত্থানে জনগণের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে আমরা বহু ভাষা ও সংস্কৃতি ও জাতির নতুন বাংলাদেশ তৈরি করবো। পুরাতনকে ঝেড়ে ফেলে, আমাদের রাষ্ট্রের নতুন যাত্রায়, আমাদের প্রথম অঙ্গীকারই হচ্ছে গণপরিষদের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান। জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা পূরণে, আমাদের এই নতুন সংবিধান, একনায়কতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদী কাঠামোর বিলোপ করে একটি বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও জনকল্যাণমুখী সেকেন্ড রিপাবলিক গঠন করবে। আমাদের নতুন রাষ্ট্র ব্যক্তির জীবন, জীবিকা, মর্যাদা ও অধিকার সংরক্ষণ করবে। এই নতুন সংবিধান আমাদের রাষ্ট্রের আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার সুনির্দিষ্ট বিভাজন ও ভারসাম্য নিশ্চিত করবে। আমরা জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করবো।

 

২। জুলাই অভ্যুত্থানের স্বীকৃতি ও বিচার এই জনপদের মানুষের উপনিবেশবিরোধী সংগ্রাম, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের কাঙ্ক্ষিত সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার লড়াই, এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানে একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গঠনের প্রত্যয়ই আমাদের প্রেরণা। আমরা জুলাইয়ে সংঘটিত গণহত্যা, শাপলা গণহত্যা, বিডিআর হত্যাকাণ্ড, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ আওয়ামী ফ্যাসিবাদের সময়ে সংঘটিত সকল মানবতা বিরোধী অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করবো। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহিদদের পরিপূর্ণ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করে আজীবন তাদের পাশে দাঁড়াবো। জুলাইয়ের জাতীয় ঐক্য ও হাজারো শহীদের আত্মত্যাগের মহিমাকে ধারণ করার জন্য আমরা জুলাইয়ের স্মৃতি রক্ষা করব এবং সবসময় ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ের সহযোদ্ধাদের পাশে থাকবো।

৩। গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সংস্কার আমরা এমন একটি ইনসাফের রাষ্ট্র গড়ে তুলতে চাই যেখানে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো হবে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পক্ষপাতহীন, নৈর্ব্যক্তিক, মানবিক ও গণমুখী। জনসেবাই হবে তাদের মূলমন্ত্র। একইসঙ্গে রাষ্ট্রের সকল সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ জবাবদিহিতা নিশ্চিতকারী প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হবে, যেন এই প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীন কাজ করে নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্বপরায়ণ হওয়ার প্রবণতাকে প্রতিহত করতে পারে। আমরা এমন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই, যেখানে জনগণ শুধু নির্বাচনের দিন সকল ক্ষমতার উৎস হবেনা, বরং রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিটি ক্ষেত্রে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে। আমরা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন আইন ও এর গঠন প্রক্রিয়ার মৌলিক পরিবর্তন সাধন করবো, এবং রাষ্ট্র-কর্তৃক নির্বাচনী ব্যয় নির্বাহের আইন করার মাধ্যমে নির্বাচনে কালো টাকার প্রভাব হ্রাস করবো এবং সৎ ও যোগ্য প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ সৃষ্টি করব।

 

৪। ন্যায়ভিত্তিক বিচারব্যবস্থা ও আইন সংস্কারআমাদের রাষ্ট্রে স্বাধীন বিচারবিভাগ ক্ষমতাবানদের পক্ষে অন্ধ অবস্থান নিবে না, বরং মজলুমকে তার প্রাপ্য ন্যায়বিচার বুঝিয়ে দিবে। এছাড়া একটি সত্যিকারের জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে আমরা ঔপনিবেশিক আমলের সকল আইনকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের ভিত্তিতে যুগোপযোগী করবো। মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করবে এমন কোন আইন তৈরি করা হবে না। আমরা বিচার বিভাগের আলাদা সচিবালয়কে পরিপূর্ণ আর্থিক স্বাধীনতা প্রদানসহ সম্পূর্ণভাবে ক্রিয়াশীল করবো। মামলার জট ও দীর্ঘসূত্রতা কমাতে আমরা বিচারক এবং আদালতের সংখ্যা বাড়াবো। আমরা মামলার নথিপত্রগুলোকে ডিজিটাল করা এবং মামলার অগ্রগতি অনলাইনে ট্র্যাকিং এর ব্যবস্থা করব। আমরা দেওয়ানী দায় (Civil liability)-এর ক্ষেত্রে আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির বিষয়ে একটি আইনগত কাঠামো প্রণয়ন করব। মানহানির মামলায় শুধু ভুক্তভোগী ব্যক্তিই আইনগত প্রতিকার চাইতে পারবেন এই বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করবো। আমরা গরিবদের জন্য বিনামূল্যে আইনগত সহায়তার ব্যস্তি বৃদ্ধি করব। কিশোর সংশোধনী ব্যবস্থার মানবিকীকরণ ও সমাজে পুনর্বাসনের সুব্যবস্থা করব।

 

৫। সেবামুখী প্রশাসন ও দুর্নীতি দমনবাংলাদেশে আমলাতন্ত্রকে দলীয়করণের মাধ্যমে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে; আমরা প্রশাসনে সকল প্রকার রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করব। আমলাতন্ত্রকে সুদক্ষ ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে আমরা উন্নত প্রশিক্ষণ এবং বিভিন্ন খাতের যোগ্য ও বিশেষজ্ঞদের সরকারে অধিকতর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবো। নিয়োগ, বদলি, পদায়ন ও প্রোমোশনের ক্ষেত্রে মেধা ও যোগ্যতাই হবে একমাত্র মানদণ্ড। সরকারি কর্ম কমিশনের সকল প্রশাসনিক নিযোগের ক্ষেত্রে সততা, নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে যথাযথ নিয়োগ-কাঠামো তৈরি করব। সরকারি সেবায় কাগজ, সময় এবং সশরীরে উপস্থিতির প্রয়োজন কমিয়ে ডিজিটাল গভার্নেন্স চালুর প্রতি আমরা বিশেষ গুরুত্ব দেব। রাষ্ট্রীয় সম্পদ চুরি-দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণের মচ্ছব, বিচারহীনতা ও বিচারে দীর্ঘসূত্রতা পরিহার করে আমরা যেকোনো দুর্নীতির দ্রুত বিচার ও সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান করবো। সরকারের যেকোনো দাপ্তরিক দুর্নীতি প্রকাশ করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে বিশেষ আইনি সুরক্ষা দিতে আমরা Whistleblower Protection আইন প্রণয়ন করবো এবং এই লক্ষ্যে বিদ্যমান সকল আইনি কাঠামোর যথাযথ সংস্কার করা হবে। এছাড়া পরিবার ও সমাজে দুর্নীতি-বিরোধী মূল্যবোধ তৈরি ও সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে আমরা শিক্ষা কারিকুলামে আমূল পরিবর্তন আনবো এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশেষ কর্মসূচি চালু করবো।

 

৬। জনবান্ধব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীআমরা এমন এক বাংলাদেশ গড়তে চাই যেখানে কোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আর সাধারণ মানুষকে ভয় দেখিয়ে, ওয়ারেন্ট ছাড়া তুলে নিয়ে যেতে না পারে। আমরা ঔপনিবেশিক আমলের ১৮৬১ ও ১৮৯৮ সালের পুলিশ আইন যুগোপযোগী করবো। আমরা গড়ে তুলবো এমন এক কাঠামো, যেখানে পুলিশ হবে মানবাধিকারের রক্ষক, নাগরিকের সেবক। আমরা পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর রাজনৈতিক অপব্যবহার বন্ধে ও তাদের বদলি-পদায়নে স্বচ্ছ ব্যবস্থা চালু করতে একটি স্থায়ী পুলিশ কমিশন গঠন করবো। যেকোনো গ্রেফতারের ক্ষেত্রে ওয়ারেন্ট বা সুস্পষ্ট কারণের উল্লেখ থাকতে হবে এবং গ্রেফতারকারী পুলিশের পদবি ও পরিচয় স্পষ্টভাবে জানাতে হবে। সুস্পষ্ট পেশাগত প্রয়োজন ব্যতীত সকল পুলিশকে দায়িত্বরত অবস্থায় ইউনিফর্ম পরতে হবে। আমরা প্রতিটি দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যকে বডি ক্যামেরার আওতায় আনবো, যাতে প্রতিটি পদক্ষেপের জবাবদিহিতা থাকে। আমরা চালু করবো কমিউনিটি-ভিত্তিক পুলিশিং এবং মানবাধিকার-কেন্দ্রিক প্রশিক্ষণ। সহিংস অপরাধের প্রতি আমাদের থাকবে জিরো টলারেন্স। আমরা র‍্যাব বিলুপ্ত করব এবং গোয়েন্দা সংস্থাকে রাজনৈতিক স্বার্থে ও মানবাধিকার লঙ্ঘনে ব্যবহার বন্ধ করতে সুস্পষ্ট আইনি কাঠামো তৈরি করব।

 

৭। গ্রাম পার্লামেন্ট ও স্থানীয় সরকার মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসছে, এতে শহরগুলোর ওপর চাপ বাড়ছে এবং গ্রামীণ অর্থনীতি দুর্বল হচ্ছে। আমরা গ্রামের স্বকীয়তা অক্ষুণ্ন রেখে শহরের সুবিধা গ্রামে পৌঁছে দিতে চাই। আমরা গ্রামে উৎপাদন ও বিনিয়োগের সুযোগ বাড়িয়ে স্বনির্ভর গ্রাম তৈরি করব। আমরা স্থানীয় পর্যায়ে শাসনব্যবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকল্পে গ্রাম পার্লামেন্ট গঠন করবো এবং এই পার্লামেন্টের হাতে স্থানীয় সমস্যা সমাধান, স্থানীয় উন্নয়ন তদারকির দায়িত্ব অর্পণ করবো।

আমরা স্থানীয় সরকার কাঠামোকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করবো এবং স্থানীয় সরকারকে স্থানীয় উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করবো। আমরা সংসদ সদস্যদের ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ করে স্থানীয় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতায়িত করবো। আমরা স্থানীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি, বাজেট প্রণয়ন ও সরকারি ক্রয়ে স্থানীয় জনগণের অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবো। একই সাথে সামাজিক জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিতকারী কাঠামোগুলো (যেমন, ওয়ার্ড সভা, উন্মুক্ত বাজেট আলোচনা) যেন যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারে তা নিশ্চিত করব। সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে নিরবিচ্ছিন্নভাবে পৌঁছে দিতে আমরা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবাভিত্তিক কার্যক্রমকে স্থানীয় সরকারের অধীনে ন্যস্ত করবো। আমরা একটি স্বাধীন স্থানীয় সরকার কমিশন গঠন করব, যা স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেন দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে, তা নিশ্চিত করবে।

 

৮। স্বাধীন গণমাধ্যম ও শক্তিশালী নাগরিক সমাজ আমরা সংবাদমাধ্যমের শতভাগ স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি এবং যথাযথ আইনি ও নীতি কাঠামোর মাধ্যমে সেটি নিশ্চিত করবো। আমরা প্রেস কাউন্সিলকে যুগোপযোগী ও কার্যকর করবো। এছাড়া নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা কর্পোরেশনের কাছে যাতে বহু গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের মালিকানা যেন কুক্ষিগত না হয়, রাজনৈতিক দলের স্বার্থের হাতিয়ার না হয়, বরং গণমাধ্যম জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকে আমরা তার আইনি কাঠামো তৈরি করব। গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা শক্তিশালী করার প্রয়াসে নাগরিক সমাজের সক্রিয়তা ও স্বাধীন মতপ্রকাশের সুযোগ অবারিত করতে নাগরিক সমাজের অংশীজনদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী নীতি কাঠামো তৈরি করা হবে। আমরা গণমাধ্যমে মিসইনফরমেশন/গুজব ও বিভ্রান্তিকর সংবাদের বিরুদ্ধে জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করবো।

৯। সার্বজনীন স্বাস্থ্য আমরা এমন একটি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা গড়ে তুলবো, যেখানে অর্থের অভাবে কেউ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হবেন না। এমন জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তুলবো, যাতে হাসপাতালে পৌঁছানোর আগে অ্যাম্বুলেন্সেই জীবনরক্ষা কারী চিকিৎসা শুরু করা যায়। সে উদ্দেশ্য সারা দেশে জিপিএস-চালিত অ্যাম্বুলেন্স ও ডিসপ্যাচ ব্যবস্থা তৈরি করব। আমরা ইলেকট্রনিক হেলথ রেকর্ড (EHR) সিস্টেম চালু করব, যাতে দেশের সকল স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান সংযুক্ত থাকবে। ফলে প্রতিটি নাগরিকের একটি ইউনিক হেলথ আইডি থাকবে, যাতে চিকিৎসা সংক্রান্ত সকল তথ্য ডিজিটালি সংরক্ষিত থাকবে, কখনো হারাবে না। এতে অপ্রয়োজনীয় টেস্ট ও ভুল চিকিৎসার সম্ভাবনা কমবে। আমরা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা শক্তিশালী করব, যাতে সকল নাগরিক নিজ এলাকাতেই মানসম্মত চিকিৎসা পেতে পারেন। পাশাপাশি একটি কার্যকর রেফারেল ব্যবস্থা চালু করব, যা জাতীয় EHR-এর সঙ্গে সমন্বিত থাকবে, যাতে রোগী এক হাসপাতাল থেকে আরেকটিতে সহজে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারেন। সেবায় বৈষম্য দূর করতে অঞ্চলভিত্তিক হৃদরোগ, ট্রমা ও অন্যান্য বিশেষায়িত কেন্দ্র স্থাপন করবো। মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার অংশ হিসেবে বিবেচনা করে আমরা এ খাতে পৃথক বাজেট, প্রশিক্ষিত জনবল এবং সেবার প্রসার ঘটাব। স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ন্যায্য বেতন, ক্যারিয়ারে অগ্রগতির সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি, নারী স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য কর্মক্ষেত্রে ডে-কেয়ার সেন্টারসহ নারীবান্ধব পদক্ষেপ গ্রহণ করব। স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতি কর্মক্ষেত্রে সহিংসতার অবসান ঘটাতে কার্যকর নীতি গ্রহণ করব। আমাদের জনপদের মানুষের জন্য নতুন ও কার্যকর চিকিৎসা আবিষ্কার করতে আমরা বিশ্বমানের একটি জাতীয় বায়োব্যাংক প্রতিষ্ঠা করব।

 

১০। জাতিগঠনে শিক্ষানীতিআমরা শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে ভবিষ্যতের উদ্ভাবন, শিল্পায়ন ও অর্থনীতির জন্য প্রস্তুত একটি দক্ষ, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলব। শিক্ষা পণ্য নয়, অধিকার। বিজ্ঞান, গণিত, প্রকৌশল ও চিকিৎসা শিক্ষায় শক্ত ভিত তৈরিতে আমাদের থাকবে বিশেষ কর্মপরিকল্পনা। আমাদের ইতিহাস, ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চার পাশাপাশি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নৈতিকতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন সুনাগরিক তৈরি করবে। শিক্ষার ভিত্তি সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কারিগরি শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হবে এবং উচ্চশিক্ষার মূল লক্ষ্য হবে মানসম্পন্ন গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞান সৃষ্টি। আমরা সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সাথে আলোচনাক্রমে বাংলা মাধ্যম, মাদ্রাসা, ও ইংরেজি মাধ্যমসহ বিদ্যমান সকল ধরনের শিক্ষার মাধ্যম ও পদ্ধতিগুলোর একটি যৌক্তিক সমন্বয় করব এবং আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র ও অর্থনীতির চাহিদার সাথে সংগতি রেখে জাতীয় পাঠ্যক্রমকে আধুনিকায়ন করব। কর্মমুখী, বৃত্তিমূলক, নার্সিং শিক্ষা এবং দক্ষতা প্রশিক্ষণকে আন্তর্জাতিক মানের, আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তুলবো, যাতে সকল নাগরিকের জন্য টেকসই কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। বিশেষ চাহিদা-সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে আমরা প্রশিক্ষিত শিক্ষক, অবকাঠামো, শিক্ষা উপকরণ ইত্যাদি বিষয়ে প্রয়োজনীয় সমন্বয় করব। আমরা শিক্ষকদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে বহির্বিশ্বের সাথে সংগতি রেখে পৃথক বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন এবং রাষ্ট্রীয় নীতি ও পদক্ষেপ গ্রহণে শিক্ষকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবো। এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে পর্যায়ক্রমে জাতীয়করণ করা হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের রাজনীতি ও তার উপর জাতীয় রাজনীতির প্রভাবের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের মতামতের ভিত্তিতে একটি গ্রহণযোগ্য নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে।

 

১১। গবেষণা, উদ্ভাবন ও তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবআমরা উন্নত বিশ্ব থেকে প্রযুক্তি স্থানান্তর ও দেশে প্রযুক্তি-জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করবো। আমরা বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি গবেষণায় সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি খাতের সহযোগিতা ও যৌথ উদ্যোগে ৫০ বছর মেয়াদি বিভিন্ন বিজ্ঞান গবেষণা প্রকল্প গ্রহণ করবো। এসব প্রকল্পের আওতায় অ্যারোনেটিক্স, মহাকাশ গবেষণা, সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স, রেডার প্রযুক্তি, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, সেমিকন্ডাকটার, কোয়ান্টাম টেকনোলজি, ন্যানো-টেকনোলোজি, নিউক্লিয়ার সায়েন্স, ও বায়োটেকনোলোজি প্রভৃতি বিষয়ে সর্বাধুনিক গবেষণা ল্যাব স্থাপন করবো। পাশাপাশি এ বিষয়ক বিশ্বের সেরা ল্যাবগুলোর সাথে সহযোগিতা স্থাপন এবং দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের প্রতিযোগিতামূলক বেতনে নিয়োগ করবো। কম্পিউটেশনাল গবেষণায় বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করার জন্য একটি ন্যাশনাল কম্পিউটিং সার্ভার ও বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক কম্পিউটিং ক্লাস্টার তৈরি করবো। বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর আউটপুট মূল্যায়নের জন্য কমিশন গঠন করব এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানে সকল প্রকার অপ্রয়োজনীয় আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করবো। তথ্য ও সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কমিশন গঠন করবো।

 

১২। ধর্ম, সম্প্রদায় ও জাতিসত্তার মর্যাদাঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হওয়া সত্ত্বেও, মানুষের ধর্মীয় পরিচয় ও আচরণকে রাজনৈতিক বিবেচনায় নির্যাতনের উপলক্ষ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আমরা সকল ধর্ম, সম্প্রদায় ও জাতিগোষ্ঠীর ধর্মীয়, নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে একটি বহুভাষা, বহু-সংস্কৃতি, বহু-জাতিভিত্তিক অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ গড়ব। আমরা ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং ঐতিহ্যের শ্রদ্ধাশীল। ইসলাম-বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িকতা, এবং জাতি-পরিচয়ের কারণে যেকোনো প্রকার বৈষম্যমূলক আচরণ, নির্যাতন ও নিপীড়নকে আমরা শক্তহাতে প্রতিহত করবো। এসব ঘটনা মোকাবেলায় আমরা স্বাধীন তদন্তের এখতিয়ার-সম্পন্ন মানবাধিকার কমিশনের একটি বিশেষ সেল গঠন করবো। আমরা হিন্দু সম্প্রদায়ের বেদখলকৃত জমি উদ্ধারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। দলিত-হরিজন-তফসিলি সম্প্রদায়সহ সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের বিকাশে শিক্ষা, স্বাস্থ্য,  কর্মসংস্থান ও সামাজিক নিরাপত্তায় আমরা বিশেষ অগ্রাধিকার প্রদান করবো। আমরা সকল জাতিসত্তার ভাষা ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও বিকাশের জন্য সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলোকে কার্যকর করবো এবং বিদ্যালয়ে নিজ-নিজ মাতৃভাষা শিক্ষার সুযোগ অবারিত করবো। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতির বিকাশ ও জাতীয় উৎসবগুলোকে সকল সংস্কৃতির মেলবন্ধনে পরিণত করতে আমাদের থাকবে সুস্পষ্ট কর্মপরিকল্পনা। আমরা স্ব-স্ব জাতিগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক অখণ্ডতা রক্ষা করবো।

 

১৩। নারীর নিরাপত্তা, অধিকার ও ক্ষমতায়নজুলাই গণঅভ্যুত্থানে নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বের পরও রাষ্ট্র জাতীয় জীবনে ব্যাপক হারে নারীদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারেনি। তাই নারীর ক্ষমতায়ন বাড়াতে নিম্নকক্ষে ১০০টি সংরক্ষিত আসনে নারী প্রতিনিধিদের সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করবো যার সংখ্যা রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির সাথে সাথে হ্রাস করা হবে। উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীদের প্রাপ্য অধিকার দ্রুত বুঝে পেতে সর্বপ্রকার আইনি সহায়তা প্রদান করা। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, পদোন্নতি ও বেতন কাঠামোতে নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করতে প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। পরিবারে ও আমাদের সার্বিক অর্থনীতিতে গৃহিণী নারীদের অবদান দেশজ উৎপাদন হিসেবে মর্যাদা পাবে ও মোট দেশজ উৎপাদনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে। প্রতিটি থানায় নারী সহিংসতা প্রতিরোধ সেল ও নারী পুলিশ নিয়োগ বাধ্যতামূলক করা হবে। ধর্ষণ মামলার বিচার প্রক্রিয়া ৬ মাসের মধ্যে সম্পন্ন করতে ফাস্ট ট্র্যাক ট্রাইব্যুনাল চালু করা হবে এবং ভিকটিমদের ব্যক্তি পরিচয় গোপন রাখার জন্য গণমাধ্যম নীতিমালা জারি করা হবে। কর্মক্ষেত্রে ব্রেস্টফিডিং ও স্যানিটারি উপকরণ ব্যবহারের নির্দিষ্ট স্থান রাখার নিয়ম করা হবে। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র, অনলাইন ও যানবাহনে নারীদের হয়রানি ও নির্যাতন প্রতিরোধে আইনি কাঠামোর যথাযথ সংস্কারের মাধ্যমে কঠোর শাস্তির বিধান করা হবে। নারীদের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে উন্নতমানের চাইল্ড কেয়ার ও বয়স্ক সেবা সার্ভিস গড়ে তোলায় প্রণোদনা দেওয়া হবে এবং স্বল্পআয়ের পরিবারকে চাইল্ড কেয়ার ভর্তুকি প্রদান করা হবে। আমরা কর্মজীবীদের পূর্ণ বেতনে অন্তত ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ও এক মাস পিতৃত্বকালীন ছুটি নিশ্চিত করব। নারীদের মাতৃত্বকালীন প্রজনন স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে আমরা যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করবো। নারীদের কর্মস্থলে নিরাপদ যাতায়াতের জন্য বিশেষ বাস সার্ভিসের ব্যবস্থা করা হবে। সকল নারীর জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসামগ্রীর প্রাপ্যতা সুলভে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। অনুন্নত ও পিছিয়ে পড়া অঞ্চল, মাদ্রাসা ও পাহাড়ি অঞ্চলের স্বল্প আয়ের পরিবারের নারীদের উচ্চশিক্ষার জন্য বৃত্তি চালু করব। বাল্যবিবাহ ও যৌতুক বন্ধের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রমে ধর্মীয় ও সামাজিক নেতাদের সম্পৃক্ত করব।

 

 

সম্পর্কিত বিষয়: