মার্কিন-চীন বাণিজ্যযুদ্ধ
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের সামনে সম্ভাবনার সুবর্ণ দ্বার

বিশ্ব অর্থনীতির সবচেয়ে প্রভাবশালী দুটি দেশ—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ শুধু এই দুই দেশেরই নয়, বরং বৈশ্বিক অর্থনীতির অনেক খাতেই বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে। এর প্রভাব সবচেয়ে স্পষ্টভাবে পড়েছে তৈরি পোশাক শিল্পে, বিশেষ করে বাংলাদেশের জন্য এটি তৈরি করছে এক বিশাল সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত।
মার্কিন সরকার সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পোশাক পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক ৯০ দিনের জন্য সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে। যদিও এই সিদ্ধান্ত সাময়িক, তবুও এর তাৎক্ষণিক প্রভাব বাংলাদেশি রপ্তানিকারক এবং মার্কিন ক্রেতাদের মধ্যে নতুন এক আগ্রহের সঞ্চার করেছে।
বিজিএমইএর তথ্য মতে, বর্তমানে প্রায় ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ বড় মার্কিন ক্রেতা ইতোমধ্যে বাংলাদেশে তাদের ক্রয় আদেশ হালনাগাদ করেছেন। এসব ক্রেতা এখন চীনের পরিবর্তে বাংলাদেশে পোশাক উৎপাদনে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন, যার ফলে রপ্তানিকারকরা ৫ থেকে ২০ শতাংশ ছাড়ে অর্ডার নিচ্ছেন—মূল্য কম হলেও দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক স্থাপনের আশায় এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তারা।
মার্কিন বাজারের প্রায় ৪০ শতাংশ জুড়ে থাকা ছোট ও মাঝারি ক্রেতারা এখনো দ্বিধাগ্রস্ত। অনেকে অর্ডার বিলম্ব করেছেন কিংবা স্থগিত রেখেছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অনিশ্চয়তার অন্যতম কারণ হলো, সাময়িক শুল্ক সুবিধার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর কী হবে, তা কেউ নিশ্চিত নয়। কিন্তু বড় ক্রেতারা—বিশ্ববিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলোসহ—বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে বেশ ইতিবাচক। তারা স্থায়ী ও নিরাপদ সরবরাহ চেইন বজায় রাখতে আগ্রহী।
স্প্যারো গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম বলেন, “আমরা মার্কিন ক্রেতাদের মধ্যে বিশেষভাবে নারীদের পোশাকের প্রতি আগ্রহ লক্ষ্য করছি। তারা এখন বাংলাদেশি সরবরাহকারীদের সঙ্গে অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে আগ্রহী।”
এছাড়া বাংলাদেশ গার্মেন্টস বায়িং হাউজ অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি একেএম সাইফুর রহমান ফারহাদ বলেন, “বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি আমাদের জন্য একটি বড় সুযোগ। তবে এই সুযোগ কাজে লাগাতে হলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি অপরিহার্য।”
শুধু মার্কিন ক্রেতারাই নয়, চীনা পোশাক প্রস্তুতকারকরাও এখন বাংলাদেশে বিনিয়োগের কথা ভাবছেন। উচ্চ শুল্কের চাপ থেকে মুক্ত থাকতে তারা এখন বাংলাদেশি কারখানায় উৎপাদন স্থানান্তর করছেন। ফলে বাংলাদেশ এখন শুধু মার্কিন ক্রেতার জন্য নয়, বরং চীনা উৎপাদকদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ একটি গন্তব্য হয়ে উঠছে।
শিল্প নেতারা মনে করছেন, চীনের বার্ষিক ১৩৭ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানির মাত্র ১০ শতাংশও যদি বাংলাদেশে স্থানান্তর হয়, তাহলে অতিরিক্ত ১৩ বিলিয়ন ডলারের বাজার তৈরি হবে। এটি বাংলাদেশের মোট রপ্তানির আকারকে আমূল পরিবর্তন করে দিতে পারে।
তবে এই বিপুল সম্ভাবনার মুখেও বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত এখনো অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে অবকাঠামোগত দুর্বলতা। বন্দরে পণ্যজট, শুল্ক প্রক্রিয়ার ধীরগতি, বিদ্যুৎ সংকট, ও সীমিত উৎপাদন সক্ষমতা এ খাতের অগ্রগতির পথে বড় বাধা।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, “বিদেশি ক্রেতা ধরে রাখতে হলে আমাদের কারখানাগুলো সচল রাখতে হবে এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে হবে। সরকার যদি এই খাতে নীতিগত সহায়তা দেয় ও সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে, তাহলে আমরা বৈশ্বিক বাজারে আরও বড় ভূমিকা রাখতে পারবো।”
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে এখন ৪০ লাখের বেশি শ্রমিক কাজ করছেন, যাদের মধ্যে ৬০ শতাংশেরও বেশি নারী। এই জনশক্তিকে দক্ষ করে তোলার পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারও এখন সময়ের দাবি। স্বয়ংক্রিয় মেশিন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI), এবং গ্লোবাল সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যারের ব্যবহার বাড়ালে এই খাত আরও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশে বর্তমানে বিশ্বের সর্বোচ্চ সংখ্যক LEED-সার্টিফায়েড সবুজ কারখানা রয়েছে। এটি আমাদের তৈরি পোশাক খাতের জন্য একটি বিরাট ইতিবাচক দিক, কারণ পরিবেশবান্ধব উৎপাদন এখন বৈশ্বিক বাজারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
২০২৪ সালে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৭.৩৪ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে, যা মার্কিন বাজারে ৯.২৬ শতাংশ শেয়ার নিয়ে চীনের পর দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। এই পরিস্থিতি ধরে রাখতে এবং আরও উন্নত করতে হলে বর্তমান সুবিধাগুলো দীর্ঘমেয়াদে রূপান্তর করতে হবে।
মার্কিন-চীন বাণিজ্যযুদ্ধ বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অনেক অনিশ্চয়তা তৈরি করলেও বাংলাদেশের জন্য এটি একটি বড় সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। তবে এই সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগাতে হলে সরকারের সমন্বিত পরিকল্পনা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শ্রমিক দক্ষতা বৃদ্ধি, এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, বরং পুরো বিশ্বের পোশাক বাজারে একটি অপ্রতিরোধ্য শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প এক যুগান্তকারী সময় অতিক্রম করছে। বৈশ্বিক বাণিজ্যনীতির পরিবর্তনের ঢেউকে যদি কৌশলগতভাবে কাজে লাগানো যায়, তাহলে আমাদের অর্থনীতিতে অভাবনীয় রপ্তানি প্রবৃদ্ধি আসতে পারে। তবে এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে প্রয়োজন হবে টেকসই অবকাঠামো, শ্রমিক দক্ষতা, পরিবেশবান্ধব কারখানা এবং বুদ্ধিদীপ্ত কূটনীতি। সাময়িক সুযোগকে দীর্ঘমেয়াদি শক্তিতে রূপান্তর করাই এখন সময়ের দাবি।