৮ ডিসেম্বর ১৯৭১: ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত সত্য’
ডিসেম্বর—বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যেমন গৌরবের আলো ছড়িয়ে আছে, তেমনি বুকের ভেতর জমে আছে অসংখ্য বেদনাবিধুর স্মৃতি। বিজয়ের দিন যতই কাছে এসেছে, ততই দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তি ভেঙে পড়েছে, আর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব আরও দুর্নিবার হয়ে উঠেছে। সেই অগ্রযাত্রারই অংশ ছিল ৮ ডিসেম্বর—এক এমন দিন, যেদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দখলদার বাহিনীর পতন আরও ত্বরান্বিত হয়। স্বাধীনতার পথ তখন আরও স্পষ্ট, আরও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে—যেন স্বপ্নটি হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে ফেলা যায়।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৮ ডিসেম্বর মুজিবনগর থেকে দেয়া এক বেতার ভাষণে জাতির উদ্দেশে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ এখন একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। পাকিস্তানি হানাদাররা এখন প্রাণ বাঁচাতে পালাচ্ছে। বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের পরাজয় এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা।
তিনি সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে শত্রুর ওপর শেষ আঘাত হানার আহ্বান জানান এবং বলেন, ‘আগামীকাল যেন কেউ অপবাদ দিতে না পারে যে আমরা আমাদের কর্তব্য পালন করিনি।’
একই ভাষণে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটো দেওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা জানান, এবং যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করেন। তার বক্তব্যে স্পষ্ট ছিল—বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে আন্তর্জাতিক রাজনীতিও তখন বড় ভূমিকা রাখছে।
এই একই দিনে ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল এস.এইচ.এফ.জে. মানেকশ পাকিস্তানি সেনাদের উদ্দেশে আকাশবাণী রেডিও থেকে হিন্দি, উর্দু ও পশতুতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। তিনি বলেন— ‘তোমাদের চারদিক ঘিরে ফেলা হয়েছে। বিমানবাহিনী অকেজো, সাহায্যের কোনো পথ খোলা নেই। তোমাদের বাঁচার একটাই উপায়—আত্মসমর্পণ।’
এই ঘোষণার পর পাকিস্তানি সেনাদের মনোবল আরও ভেঙে পড়ে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযান দ্রুতগতিতে এগোতে শুরু করে।
৮ ডিসেম্বর কলকাতায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মুখপাত্র জানান— বাংলাদেশের সব পাটকল, চা-বাগান, ব্যাংক, বীমা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান সরকারি করা হবে এবং খুব দ্রুত সুষ্ঠু প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু হবে। জেলা প্রশাসক নিয়োগ, মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণসহ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রূপরেখা তখন স্পষ্ট হতে শুরু করে। জাতীয় পতাকা ও রাষ্ট্রগঠনের প্রস্তুতি—সবকিছুই যেন বিজয়ের আগমনী বার্তা দিচ্ছিল।
৮ ডিসেম্বর পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী নুরুল আমীন ও পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্কের উদ্দেশে রওনা হন। ইয়াহিয়া খান দেশবাসীর কাছে যুদ্ধ তহবিলে অর্থ চেয়ে বিবৃতি দেন—যা প্রমাণ করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তখন ভীষণ চাপের মুখে। সারা দেশে তারা ‘যুদ্ধ তহবিল’ গঠনের আহ্বান জানাতে বাধ্য হয়।
এদিন জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন বলেন— ‘বাংলাদেশ এখন বাস্তব সত্য। পাকিস্তানের উচিত এ সত্য মেনে নেওয়া।’
এদিকে জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্ট ঢাকায় অবস্থানরত কর্মকর্তাদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার জন্য ভারত–পাকিস্তানের কাছে একটি নিরপেক্ষ নিরাপদ এলাকা চেয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক পরিসরেও তখন যুদ্ধের চিত্র স্পষ্ট—বাংলাদেশের জন্ম আর আটকে রাখা যাবে না।
জাতিসংঘে ভোটাভুটি নিয়ে দুটি বার্তা সংস্থার বরাত দিয়ে ইত্তেফাক লিখে, প্রস্তাবের পক্ষে ভোট পড়ে ১০৪টি। আর বিপক্ষে ভোট দেয় ১১ সদস্য রাষ্ট্র। প্রস্তাবটির একটি শর্তে বলা হয়, বাঙালি শরণার্থীরা যাতে স্বেচ্ছায় স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে পারে, পাকিস্তানকে সে রকম অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তবে এই অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা নিয়ে আপত্তি ছিল পাকিস্তানের।
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, অধিবেশনে দেওয়া ভাষণেই ইসলামাবাদের প্রতিনিধি আগা শাহি জানান, তার সরকার ‘বাংলার বিদ্রোহীদের’ সঙ্গে আলোচনায় রাজি নয়।
জাহানারা ইমাম তার ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইয়ে লিখেছেন, ৮ ডিসেম্বর বুধবার রেডিওতে আবার ঘোষণা দেওয়া হয়, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কারফিউ ও ব্ল্যাকআউট (সন্ধ্যা থেকে ভোর ৫টা) বলবৎ থাকবে।
ডিসেম্বরের শুরুর দিক থেকেই ঢাকায় কারফিউ ও ব্ল্যাকআউট জারি হয়। ৮ ডিসেম্বর নতুন করে ঘোষণা দেওয়ার পর এর প্রভাব পড়ে টর্চলাইটের বাজারে। এ নিয়ে পরদিন দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় লেখা হয়, ঢাকাসহ আশপাশে নিষ্প্রদীপ ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর জনসাধারণের মধ্যে টর্চলাইট ও টর্চের ব্যাটারি কেনার হিড়িক পড়েছে। শহরের বিভিন্ন মণিহারি দোকানে টর্চের যে মজুত ছিল, তা শেষের দিকে। পেনসিল ব্যাটারির যে টর্চ কিছুদিন আগে ছয় টাকায় বিক্রি হয়েছে, সেগুলো পৌনে আট থেকে সাড়ে আট টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ ও শত্রুমুক্তি
৮ ডিসেম্বর ছিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অন্যতম ঘটনাবহুল দিন। দেশের বিভিন্ন জেলা এই দিনে শত্রুমুক্ত হয়ে বিজয়ের পথে আরো এক ধাপ এগিয়ে যায়।
কুমিল্লা হানাদারমুক্ত
ভারতীয় মিত্রবাহিনীর শিখ জাট ব্যাটালিয়ন ও মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বিত অভিযানে দুপুরের দিকে কুমিল্লা শহরে প্রবেশ করা হয়। এতে হানাদাররা পালাতে বাধ্য হয়। পরে টাউন হলে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। দিনের শেষে জেনারেল অরোরা কুমিল্লা বিমানবন্দরে অবতরণ করলে শহরবাসী করতালিতে তাকে স্বাগত জানায়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্ত
ভারতীয় সেনারা উজানিসার ও রেললাইন দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হয়ে বিনা বাধায় শহরটি মুক্ত করে। একইদিন মুক্তিযোদ্ধারা আশুগঞ্জমুখী অভিযান চালান, যা ঢাকার পথ আরও উন্মুক্ত করে দেয়।
বরিশাল হানাদারমুক্ত
দুপুরে ভারতীয় বাহিনীর বিমান হামলার পর পাকিস্তানি সেনারা নৌপথে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা শহরে প্রবেশ করে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন।
চাঁদপুর বিজয়
৮ ডিসেম্বর চাঁদপুর নদী বন্দরের কাছে বিমান থেকে বোমা হামলা চালায় ভারতীয় বাহিনী। বোমা হামলায় হানাদার বাহিনীর বহু নৌযান ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এদিনই চাঁদপুরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।
পিরোজপুর মুক্ত
৭ ডিসেম্বর রাতেই মুক্তিযোদ্ধারা পিরোজপুরের দক্ষিণ প্রান্তে পৌঁছান, এবং ৮ ডিসেম্বর ভোরে পাকিস্তানি সেনারা কচা নদী দিয়ে বরিশালের দিকে পালিয়ে যায়। এভাবে পুরো জেলা শত্রুমুক্ত হয়।



























