দীর্ঘ ছুটিতে ফাঁকা রাজধানী, নিরাপত্তায় কড়া নজর প্রশাসনের

ঈদুল ফিতরের টানা নয় দিনের ছুটিতে রাজধানী ঢাকা অনেকটাই ফাঁকা হয়ে পড়ছে। হাজার হাজার মানুষ গ্রামের টানে শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।
বন্ধ হচ্ছে অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান,
দোকানপাট। ফলে ঈদের সময় ঢাকার চিরচেনা কোলাহল হঠাৎ করেই স্তব্ধ হয়ে যায়। আর এই নীরব শহরের নিরাপত্তা নিয়েই বাড়ছে উদ্বেগ।
নগরবাসী আশঙ্কা করছেন, তালাবদ্ধ ফ্ল্যাট, ফাঁকা রাস্তা ও কম জনসমাগমের সুযোগ নিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে চুরি, ছিনতাই, অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টিসহ বিভিন্ন অপরাধী চক্র। ইতোমধ্যে গত কিছুদিনে ছিনতাইয়ের বেশ কিছু ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে জনসমক্ষে কুপিয়ে মোবাইল ও ব্যাগ ছিনিয়ে নিচ্ছে দুর্বৃত্তরা। এসব ঘটনা আতঙ্ক ছড়িয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে।
গত ৫ আগস্টের পর দীর্ঘদিন কারাগারে থাকা একাধিক পেশাদার ছিনতাইকারী ও ডাকাত চক্রের সদস্যদের মুক্তি পাওয়ার পর থেকে তাদের তৎপরতা বাড়ছে বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে। ফলে এবার ঈদের ছুটিতে অপরাধের আশঙ্কা আরও প্রবল হয়েছে।
এই পরিস্থিতি মাথায় রেখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি), র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), গোয়েন্দা সংস্থা, সহায়ক পুলিশ ফোর্সসহ বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা সমন্বিতভাবে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছেন। শহরের প্রবেশ ও বহির্গমন পথে বসানো হয়েছে বাড়তি চেকপোস্ট। বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চঘাট, রেলস্টেশন, মার্কেট, বিপণিবিতান, বিনোদন কেন্দ্র, জুয়েলারি মার্কেট, কূটনৈতিক এলাকা, ব্যাংকপাড়া—সব এলাকাতেই চলছে বিশেষ টহল।
পুলিশ সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, ঈদের ছুটিতে ঢাকায় ৬০০টি পুলিশ টহল দল ২৪ ঘণ্টা কাজ করবে। প্রতিদিন মহানগরে ৭৫টি চেকপোস্ট পরিচালিত হবে। নিয়মিত পুলিশের পাশাপাশি থাকবে ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট, ডিবি, এপিবিএন এবং পিওএম। এ ছাড়া, র্যাবও মাঠে থাকবে পূর্ণাঙ্গ শক্তি নিয়ে। ঢাকার ভেতরে থাকবে ৯৯টি এবং সারা দেশে ৩৫২টি মোবাইল টহল দল। গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সদস্যদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়েছে।
ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী জানান, পুলিশ জনগণের পাশে আছে, তবে নাগরিকদেরও নিজ নিজ বাসা, ফ্ল্যাট বা দোকানের নিরাপত্তা নিজের দায়িত্বে নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, “আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি, তবে আপনাদের সহযোগিতাও জরুরি।”
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিকুর রহমান জানান, বড় বড় ঈদের জামায়াত, বিনোদন কেন্দ্র, জনসমাগমস্থলসহ বিভিন্ন স্পর্শকাতর এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাদা পোশাকে নজরদারি ও টহল বাড়ানো হয়েছে। একইসঙ্গে চাঁদাবাজ, ছিনতাইকারী ও চুরি চক্রের তৎপরতা রোধে গোপন অভিযানে নামা হয়েছে।
পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এস এন মো. নজরুল ইসলাম বলেন, এবারের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় নতুন যুক্ত হওয়া সহায়ক ফোর্স মার্কেট ও আবাসিক এলাকার নিরাপত্তা রক্ষায় কাজ করবে। ঈদের সময় গোয়েন্দা তৎপরতা ও ভার্চুয়াল নজরদারি আগের চেয়ে অনেক বেশি বাড়ানো হয়েছে।
পুরান ঢাকা, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, গুলশান, বারিধারা, মতিঝিল—এইসব এলাকায় নিরবিচারে চলছে চেকপোস্ট, সিসিটিভি পর্যবেক্ষণ এবং রাতভর টহল। রাজধানীর প্রতিটি থানাকে দেওয়া হয়েছে নির্দিষ্ট নিরাপত্তা নির্দেশনা। সড়ক, মহাসড়ক ও নৌপথে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিক উদ্ধারকাজ পরিচালনার জন্য ফায়ার সার্ভিসের রেসকিউ টিম, ডুবুরি, অ্যাম্বুলেন্স ও অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
তবে সাধারণ মানুষের আস্থা এখনো পুরোপুরি ফিরেনি। অনেকেই বলেছেন, পুলিশ থাকলেও চোর, ছিনতাইকারীরা সুযোগ পেলেই হামলা চালায়। কলাবাগান এলাকার বাসিন্দা শারমিন আক্তার বলেন, “বাসা ছেড়ে গ্রামে যাচ্ছি, কিন্তু মনটা শান্ত না। তালা দিয়েছি, নিরাপত্তাকর্মী আছে, তবু আশঙ্কা রয়েই যায়।”
একই কথা বলেন বংশালের ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমান, “আমার দোকানে একবার ঈদের সময় চুরি হয়েছিল। এবার একটু নিশ্চিন্ত মনে যাচ্ছি, কারণ পুলিশি টহল চোখে পড়ছে, কিন্তু পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছি না।
পুলিশ সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতিটি ঘটনা মনিটরিং করা হচ্ছে। সন্দেহজনক কিছু দেখলেই তাৎক্ষণিকভাবে থানা, কন্ট্রোল রুম অথবা জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন করতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, ঈদের আনন্দ নির্বিঘ্ন করতে প্রশাসনের প্রস্তুতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। তবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নাগরিক সচেতনতা, পারস্পরিক সহযোগিতা এবং নিজের দায়িত্ব নিজে পালন করাটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশের পাশাপাশি সবার অংশগ্রহণই রাজধানীকে রাখবে শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ।#