ঈদের ভরসায় কামারশিল্প, বাকি বছর জুড়ে টানাপোড়েন

কোরবানির ঈদ যত ঘনিয়ে আসছে, ততই জেগে উঠছে শহরের কামারপল্লিগুলো। ঢাকার কারওয়ান বাজার, খিলগাঁও, মালিবাগ, রামপুরা, পুরান ঢাকা ও অন্যান্য এলাকায় কামারদের কর্মশালায় এখন দিনরাত চলছে নিরবচ্ছিন্ন কর্মযজ্ঞ। ঈদের কোরবানির জন্য প্রয়োজনীয় দা, বটি, চাপাতি ও ছুরি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কারিগররা।
ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে এক মাস আগেই কাজ শুরু করেছেন অনেকে। এখন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কামাররা নিঃশ্বাস ফেলারও সময় পাচ্ছেন না। কারওয়ান বাজারে দেখা গেলো—লোহার গন্ধ, আগুনের আঁচ আর হাতুড়ির শব্দে মুখর কামারশালাগুলো।
কারিগর কাজল কর্মকার বললেন, “ঈদের সময়টাতে কাজের চাপ এত বেশি যে, বিশ্রামের সুযোগ নেই। সারা বছরের মূল উপার্জন হয় এই একটা মাসে।”
তবে উৎসবের এই মৌসুমেও স্বস্তি নেই তাদের। লোহা, কয়লা ও শ্রমিকের মূল্যবৃদ্ধিতে উৎপাদন খরচ বেড়েছে অনেকটাই। দুই মাস আগেও প্রতি বস্তা কয়লা পাওয়া যেত ৪০০-৪৫০ টাকায়, এখন তা কিনতে হচ্ছে ৮০০-৮৫০ টাকায়।
এই কারণে সরঞ্জামের দামও বেড়েছে। বড় ছুরি মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ১৫০০ টাকায়, মাঝারি ছুরি ৪০০-৬০০ টাকা, চাপাতি ৭০০-৮০০ টাকা, দেশি কুড়াল ৯০০-১০০০ টাকা এবং ‘খাইট্টা’ ৫০০-১০০০ টাকায়। কেজি দরে বঁটি-দা-চাপাতি বিক্রি হচ্ছে ৭০০-৮০০ টাকায়।
সরঞ্জাম কিনতে আসা ক্রেতা সারোয়ার হোসেন বলেন, “গত বছর যে দা ১২০০ টাকায় কিনেছিলাম, এবার তার দাম চাইছে ১৬০০ টাকা। লোহার দাম বাড়ায় কামাররাও দাম বাড়াচ্ছেন, কিন্তু আমাদেরও তো সীমাবদ্ধতা আছে।”
বিক্রেতারা জানালেন, একসময় পাকা লোহায় তৈরি দা-চাপাতি ছিল খুবই জনপ্রিয়। বর্তমানে কেউ কেউ মিশ্র লোহা ব্যবহার করছেন। তবে দেশি পাকা লোহার পণ্যের মান এখনো ভালো। এর মধ্যেই চীন থেকে আমদানি করা কমদামী ও আকর্ষণীয় দেখতে ছুরি-কুড়াল বাজারে জায়গা করে নিচ্ছে।
এক বিক্রেতা জানান, “চায়নিজ সরঞ্জামের দাম কম। তাই অনেকেই একবার ব্যবহার করে ফেলে দিচ্ছেন। কিন্তু টেকসই না বলে অনেকেই আবার দেশে তৈরি জিনিসে ফিরে আসেন।”
দাম বাড়লেও কামারদের হাতে আসছে না কাঙ্ক্ষিত মুনাফা। কাঁচামাল, শ্রম আর খরচের তুলনায় লাভ অনেক কম। এ পেশার সঙ্গে জড়িতদের অনেকে এখন বিকল্প পেশার দিকে ঝুঁকছেন।
মো. আলমগীর নামে এক কামার বলেন, “ঈদের সময়ই মানুষ আমাদের খোঁজে। সারাবছর হাতে কাজ থাকে না। আগে বিভিন্ন জেলা থেকেও মানুষ আসতো, এখন অনেকেই স্থানীয় বাজার বা অনলাইনেই জিনিস কিনে নেয়।”
কারিগর রবিন কর্মকার জানান, “আমরা এই পেশা ছেড়ে যেতে চাই না, কিন্তু আমাদের ছেলে-মেয়েরা আর আসতে চায় না। কারণ এই পেশায় ভবিষ্যৎ নেই। ঈদের এই একটা মাসই কিছুটা স্বস্তি দেয়।”
ঈদের মৌসুমে সাময়িকভাবে আয় বাড়লেও বছরের বাকি ১০ মাস কামারদের জন্য অপেক্ষা করে টানাপোড়েন, কাজের অভাব ও অনিশ্চয়তা। গ্রামীণ কামারশিল্প যেখানে প্রায় নিঃশেষ হয়ে গেছে, শহরেও তা এখন শুধুই টিকে থাকার লড়াই।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কামারশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজন কাঁচামালের সহনীয় দাম, সহজ শর্তে ঋণ, প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং সরকারিভাবে এই পেশাকে ছোট উদ্যোক্তা খাতে অন্তর্ভুক্ত করা।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)-এর পরিচালক (শিল্প উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ) কাজী মাহবুবুর রশিদ বলেন, “দেশীয় কামারশিল্প আমাদের ঐতিহ্যের অংশ হলেও সময়ের সাথে এটি টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে। আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব, কাঁচামালের উচ্চমূল্য এবং বাজারসংযোগের ঘাটতি এ শিল্পের প্রধান চ্যালেঞ্জ। বিসিক ইতিমধ্যে কারিগরি প্রশিক্ষণ ও ক্ষুদ্র ঋণ সহায়তা প্রকল্প চালু করেছে, তবে আরও বড় পরিসরে উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা কামারশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে অঞ্চলভিত্তিক হস্তশিল্প ক্লাস্টার গঠনের পরিকল্পনা নিয়েছি, যাতে কর্মসংস্থান ও টেকসই আয় নিশ্চিত হয়। ঈদ মৌসুমে যেমন চাহিদা বাড়ে, তেমনি সারা বছর ধরে বিকল্প বাজার সৃষ্টি করাও জরুরি।”
ঐতিহ্যের এই শিল্প শুধু একটি পেশা নয়, বরং আমাদের সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ঈদের মৌসুমে একটু আলো পেলেও সারা বছরের অন্ধকার দূর করতে প্রয়োজন পরিকল্পিত উদ্যোগ।