বুধবার ১৯ নভেম্বর ২০২৫, ৫ অগ্রাহায়ণ ১৪৩২

নূহ আব্দুল্লাহ

প্রকাশিত: ১৯:০২, ১৯ নভেম্বর ২০২৫

কুষ্টিয়ার মিরপুরে শিক্ষার্থীরা অসহায় শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকেরা শেখাচ্ছেন না কিছুই

কুষ্টিয়ার মিরপুরে শিক্ষার্থীরা অসহায় শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকেরা শেখাচ্ছেন না কিছুই

“আমরা যদি কোনো বিষয়ে জানার জন্য প্রশ্ন করি, শিক্ষক জবাব দেন, আমি তোমাদের কেন এটা শেখাবো? আমার কি আর কোনো কাজ নেই?” কথাটি বলছিল কুষ্টিয়ার মিরপুরের এক সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী। এরপর সে নিজেই ভূমিকা জুড়ে দিয়ে  বললো, “শিক্ষক আমাদের শেখাবে না তো কে শেখাবে? শেখানো তো অন্য কারও পেশা নয়, শেখানো তো তারই পেশা। এজন্যই তো তিনি সেখানে শিক্ষকতা করেন। কিন্তু তারা আমাদের কিছু শেখায় না।”

এমন ঘটনাই ঘটছে মিরপুরের বেশিরভাগ স্কুলে। অবস্থা দেখে মনে হয় যেন শিক্ষা দিতে নয়, অন্য কোনো উদ্দেশ্যে স্কুলগুলো খুলে রাখা হয়েছে!

এক প্রাথমিকের শিক্ষার্থী বললো, “আমাদের শিক্ষক বলেন, তোমরা পড়াশুনা শিখে বড় কিছু হলেই বা আমাদের কি? না হলেই বা আমাদের কি?” 

বর্তমানে মফস্বলের বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের এ ধরনের আচরণের অনেক বক্তব্য পাওয়া গিয়েছে কিছু শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে।

যার আরও কয়েকটি উদাহরণ এখানে তুলে ধরা হলো: ১। একটি মাদ্রাসার এক মেয়ে শিক্ষার্থী আফসোস সহকারে বলছিল, “শ্রেণিকক্ষে স্যার পড়া বুঝিয়ে দেন না। তার কাছে প্রাইভেট পড়তে গেলে সেখানে পড়া বুঝিয়ে দেন। আর তার কাছে পড়তে না গেলে খারাপ ব্যবহার করেন, ক্লাসের মধ্যে বাজে কথা বলেন।”

২। একটি বালিকা বিদ্যালয়ের আরেকজন শিক্ষার্থী তাদের ইংরেজি শিক্ষক সম্পর্কে জানালো, একজন শিক্ষক তার ক্লাসে ”স্পন্টেনিয়াস” শব্দের উচ্চারণ করতে পারছিলেন না।

৩। আরেক বিদ্যালয়ের একজন অংকের শিক্ষককে শিক্ষার্থী প্রশ্ন করেছিল, “স্যার, বৃত্ত কি সরল রেখা নাকি বক্ররেখা?” শিক্ষক উত্তর দিয়েছেন ”বৃত্ত একটি সরল রেখা”। ওই ছাত্র যখন আবার প্রশ্ন করেছে- ”স্যার, বৃত্ত কীভাবে সরলরেখা হয়? ওটা তো বাঁকা”।

তখন শিক্ষক বলেছেন, “বাসায় গিয়ে একটা সুতো দিয়ে একটা বৃত্ত আঁকবে। তারপর সুতোটার দুই মাথা সোজা করবে। দেখবে বৃত্ত একটি সরল না কি বক্র রেখা।

শিক্ষার্থী আবার যখন প্রশ্ন করে, স্যার “বৃত্ত” থাকা অবস্থায় কোন রেখা? এই প্রশ্নটি করার সময় তাকে পেছনের বেঞ্চে বসে থাকা ওই স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়া শিক্ষার্থীরা ধমক দিয়ে বলে, “অ্যাই, তুই স্যারের চাইতে বেশি বুঝিস? বেশি জানিস?”

৪। আরেক স্কুলে এক অংকের শিক্ষক অংক যে শর্ত দিয়েছে তা না করে অন্যভাবে অংক করেছে। যেমন, অংক বলছে “ডেকের যাত্রী কেবিনের যাত্রীর তিনগুণ। ডেকের যাত্রীকে X ধরে সমীকরণ তৈরি করো”। কিন্তু তিনি কেবিনের যাত্রীকে X ধরে সমীকরণ তৈরি করেছেন।

৫। একজন শিক্ষক ক্লাসে একজন শিক্ষার্থীকে বলছেন, “তুই তো রিডিং-ই পড়তে পারিস না, তোকে দিয়ে পড়াশুনা হবে না।”

৬। একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একজন বিজ্ঞান শিক্ষক ব্যক্তিজীবনে নামাজ-কালাম পড়েন, ধর্ম পালন করেন। তিনি শ্রেণিকক্ষে বললেন, ”মেয়েদের মাথায় ঘিলু অর্ধেক থাকে। সুতরাং মেয়েদের দিয়ে ভালো কিছু হতে পারে না।” আবার পরবর্তী ক্লাসে এসে তিনি বললেন, “মেয়েরা, ইহকাল কিন্তু সব নয়, অনন্তকাল হচ্ছে পরকাল। সুতরাং ইহকাল নয়, পরকালের চিন্তা করো, পরকালের কাজ করো। পড়াশুনার চাইতে ধর্মকর্ম বেশি বেশি পালন করো। পরকালে অনন্ত সুখ লাভ করবে”।
এ ব্যাপারে কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বেশিরভাগ শিক্ষক রেগে যান এবং কথা বলতে রাজি হন না ও তাচ্ছিল্য দেখিয়ে চলে যান।

এই প্রতিবেদকের উদ্দেশ্যে তাদের কয়েকজনের বক্তব্য ছিল এরকম, “সাংবাদিকতার নামে আপনি বাড়াবাড়ি করছেন!”
বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে মাদকদ্রব্য সহজলভ্য এখনও বিদ্যালয়ে তথা প্রথম শ্রেণিতেও ভর্তি হয়নি এমন কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায় তারা ধুমপান করে। এমনকি তাদের মধ্যে কেউ কেউ গাঁজা, ফেনসিডিল ও জুতার আঠার ঘ্রাণ গ্রহণ করে নেশা করে থাকে।

”বিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০ গজ (বা প্রায় ৩২৮ ফুট) পরিসীমার মধ্যে ধূমপান সামগ্রীর দোকান থাকতে পারবে না।” এটি তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। যার প্রধান উদ্দেশ্য হলো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছাকাছি যাতে তামাকজাত পণ্য সহজলভ্য না হয়, তা নিশ্চিত করা। এই নিয়মটি তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের একটি অংশ এবং এটি বাস্তবায়নের জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা কাজ করেন।

কিন্তু বাস্তবে এই আইনটি কার্যকর হচ্ছে না বলে দেখা যাচ্ছে। মিরপুরের একটি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ফটকের ঠিক পাশের দোকানে সিগারেট পাওয়া যায়। এবং দোকানটিতে দুইবার গিয়ে প্রথমবার “ভিতরে এত ধোঁয়া কেন?” প্রশ্ন করলে দোকানি রেগে যান। বলেন, “ভিতরে কোনো ধোঁয়া নেই।” বলে ভিতরে যেতে বাধা দেন। পরেরবার একজন ধুমপায়ী হিসেবে “ভিতরে বসা যাবে?” বলে অনুমতি নিলে অনুমতি মেলে এবং ভিতরে গিয়ে নিম্নমাধ্যমিক ও প্রাইমারী পড়ুয়া ১০-১২ জন শিক্ষার্থীকে দেখা যায় ভিতরে বসে তারা ধুমপান করছে।

ওই দোকানে নানা ধরনের সিগারেট পাওয়া যায়। এবং দোকানিকে “এই সিগারেটের চাইতে এটা ভালো” বলে শিক্ষার্থীদের কাছে সিগারেট বিক্রির সময় পরামর্শও দিতে দেখা যায়।

দোকানটি যে মাঠের দক্ষিণ পাশে, ওই মাঠেরই উত্তরপাশে উপজেলা পরিষদ অবস্থিত।

এসব ব্যাপার নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নাজমুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “আমরা ইতোমধ্যে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চিঠি পাঠিয়েছি—যেখানে প্রতিষ্ঠানের সামনে স্থাপনের জন্য উল্লেখ আছে যে প্রতিষ্ঠানের আশপাশের নির্দিষ্ট ১০০ গজের মধ্যে ধূমপান নিষিদ্ধ। অনেক প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে এসব সাইনবোর্ড প্রদান করেছে। কিছু প্রতিষ্ঠানের সামনে এগুলো দৃশ্যমানও রয়েছে। আমাদের কার্যক্রম চলমান আছে, এবং প্রয়োজন অনুযায়ী মোবাইল কোর্ট বা অন্যান্য আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। তবে অভিযোগ কম আসায় দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়। তারপরও, আমার অবস্থান থেকে যথাসম্ভব ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করছি। বাস্তবতা হলো—শিক্ষকদের আগ্রহ এখনো তুলনামূলক কম। যৌন হয়রানি প্রতিরোধক সেলের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে বেশিরভাগ স্কুলেই এখনো নেই। তবে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে আমরা অবশ্যই তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে সক্ষম।” 

সর্বশেষ

জনপ্রিয়