আইআরআইয়ের মূল্যায়ন প্রতিবেদন
নির্বাচনী পরিবেশ এখনও নাজুক
ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনকে শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য করতে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) আটটি প্রস্তাব দিয়েছে। বুধবার ওয়াশিংটন থেকে প্রকাশিত আইআরআইয়ের প্রতিবেদনে এসব সুপারিশ উঠে আসে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কিছু প্রশংসাযোগ্য উদ্যোগ নিয়েছে। তবে এসব প্রচেষ্টার পরও নির্বাচনের পূর্ববর্তী পরিস্থিতি এখনো পুরোপুরি স্থিতিশীল নয়। বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা দেখা যাচ্ছে, স্থানীয় প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে এবং নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি আস্থাহীনতার লক্ষণ রয়ে গেছে। জনগণের বিশ্বাস ধরে রাখতে সরকার, রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে ধারাবাহিক ও খোলামেলা সংলাপ বজায় রাখা জরুরি।
আন্তর্জাতিক নীতি ও নির্বাচনি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত একটি প্রাক-নির্বাচনি মূল্যায়ন মিশন বাংলাদেশে পাঠায় আইআরআই। বাংলাদেশে ২০ থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত তারা পরিস্থিতি মূল্যায়ন করেন। নির্বাচনি পরিবেশ ও গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণের সম্ভাবনা মূল্যায়নের উদ্দেশ্যে তারা নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্মকর্তা এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারা মোট ২১টি বৈঠকে ৫৯ জন অংশগ্রহণকারীর সঙ্গে আলোচনা করেন।
আইআরআই বাংলাদেশের প্রাক-নির্বাচনি পরিবেশ মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছে, তরুণদের নেতৃত্বাধীন দলের আবির্ভাব ও প্রবাসী বাংলাদেশিসহ প্রথমবারের মতো বিপুলসংখ্যক ভোটারের অংশগ্রহণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে সম্ভাব্য এক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এ পরিস্থিতি দেশের গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণে তাদের ধারাবাহিক ভূমিকারও আভাস আছে। আইআরআই বলেছে, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থী মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব, নারীর অপ্রতুল প্রতিনিধিত্বের পাশাপাশি উগ্রপন্থি আন্দোলনের প্রতি ক্রমবর্ধমান আগ্রহ ও চরমপন্থি গোষ্ঠীগুলোর অসহিষ্ণু বয়ানের মতো চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। এসব বিষয় বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক ভিত্তিকে নড়বড়ে করে দিতে পারে। জুলাই জাতীয় সনদের বাস্তবায়ন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর গণতান্ত্রিক চর্চা ছাত্র আন্দোলন থেকে উদ্ভূত মূল্যবোধগুলোকে কতটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়, সেটা বাংলাদেশের রূপান্তরের ভবিষ্যৎ যাত্রা ঠিক করে দেবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সম্ভাব্য জাতীয় নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বিশ্বাসযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সংস্কার আন্দোলনের অঙ্গীকার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে কিনা, তা আগামী কয়েক মাসে স্পষ্ট হবে। নিরপেক্ষতা বজায় রাখা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংস্কার কর্মসূচির টেকসই বাস্তবায়নের ওপর অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য নির্ভর করছে। এতে বলা হয়, জুলাই জাতীয় সনদ গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণের জন্য একটি নীলনকশা তুলে ধরেছে। তবে এর বাস্তবায়ন অনেকাংশেই পরবর্তী সংসদের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। ধারাবাহিক সংলাপ, স্বচ্ছ নির্বাচন প্রশাসন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর বিশ্বাসযোগ্য অংশগ্রহণের মাধ্যমে রূপান্তর প্রক্রিয়ার প্রতি জনআস্থা জোরদার করা অপরিহার্য। নির্বাচন সামনে রেখে আট দফা সুপারিশ করা হয়। এগুলো হচ্ছে-
জুলাই চার্টারের বাস্তবায়ন চূড়ান্ত করা : প্রথম সুপারিশে বলা হয় রাজনৈতিক দলগুলোকে জুলাই জাতীয় চার্টার চূড়ান্তকরণ এবং তা কার্যকর করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া উচিত। এর মধ্যে রয়েছে সময়সীমা নির্ধারণ, নির্দিষ্ট ধারার বিষয়ে বাকি থাকা মতবিরোধ সমাধান এবং গণপরিষদের সামনে তাদের উদ্দেশ্য ঘোষণা করা যে তারা গণতান্ত্রিক সংস্কারগুলোকে সমর্থন করবে। অস্থায়ী সরকার এবং নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে জুলাই চার্টারের গণভোট পরিচালনার জন্য একটি সুস্পষ্ট এবং বৈধ কাঠামো স্থাপন করা উচিত। গণভোটের ক্রম এবং সময় নির্ধারণের সিদ্ধান্ত স্বচ্ছ আইনগত ব্যাখ্যা এবং বিস্তৃত রাজনৈতিক সম্মেলনের ভিত্তিতে গ্রহণ করা উচিত। গণভোটের উদ্দেশ্য, প্রক্রিয়া এবং প্রভাব সম্পর্কে জনগণের সঙ্গে স্পষ্ট ও ধারাবাহিক যোগাযোগ রক্ষা করা অপরিহার্য, যা সংস্কার এজেন্ডা এবং নির্বাচনি প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থা নিশ্চিত করবে।
নাগরিক শিক্ষাকে শক্তিশালী করা এবং গণতান্ত্রিক সংস্কার সমর্থন করা : জুলাই চার্টারের বিষয়বস্তু বোঝার জন্য দৃঢ় নাগরিক শিক্ষার উদ্যোগ অপরিহার্য। নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল, মিডিয়া এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে জাতীয় স্তরে ভোটারদের শিক্ষিত করার প্রচেষ্টা অগ্রাধিকার দিতে হবে। এর মধ্যে থাকবে সংবিধান সংশোধন, নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং প্রস্তাবিত সংস্কারের প্রভাবের ব্যাখ্যা। নাগরিক শিক্ষার প্রচেষ্টা সর্বজনীন, সহজলভ্য এবং প্রথমবার ভোটার, যুবক, নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে তৈরি হতে হবে।
নারীদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ উৎসাহিত করা : রাজনৈতিক জীবনের সব স্তরে নারীরা এখনো অপ্রতিনিধিত্বমূলক। রাজনৈতিক দলগুলোকে নারীদের অধিকার সুরক্ষা এবং নেতৃত্ব বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হবে। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত নারী প্রার্থী নিয়োগ, নেতৃত্ব প্রশিক্ষণ প্রদান এবং সংরক্ষিত আসনের বাইরে অংশগ্রহণ সমর্থন করা। দলগুলোকে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় নারী ভোটার এবং প্রার্থী উভয়ের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।
প্রার্থী নির্বাচনের প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করা : রাজনৈতিক দলগুলোকে অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক অনুশীলন শক্তিশালী করতে হবে। প্রার্থী নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ, নিয়মিত এবং পক্ষপাত বা জোরপূর্বক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। প্রার্থী মনোনয়নকালে স্থানীয় স্তরের সহিংসতা কমানো এবং নারীদের প্রার্থী ও প্রচারক হিসাবে অংশগ্রহণের সুরক্ষা নিশ্চিত করা উচিত।
নিরাপত্তা পরিকল্পনায় সমন্বয় বৃদ্ধি : নির্বাচন কমিশনকে সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় বৃদ্ধি করতে হবে, স্থানীয় উত্তেজনা কমাতে এবং নির্বাচনের সময় সহিংসতা প্রতিরোধ করতে। যৌথ পরিকল্পনা, পরিষ্কার যোগাযোগ প্রটোকল এবং সমন্বিত প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থা জনসাধারণের নিরাপত্তা বজায় রাখতে এবং ভোটার আস্থা শক্তিশালী করতে অপরিহার্য।
নাগরিক নির্বাচনি পর্যবেক্ষণে স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি : নির্বাচন কমিশনকে নাগরিক পর্যবেক্ষক সংস্থা অনুমোদনের স্পষ্ট ও সহজলভ্য মানদণ্ড প্রকাশ করতে হবে। এর মধ্যে থাকবে যোগ্যতা শর্ত, মূল্যায়ন মানদণ্ড এবং পর্যালোচনা সময়সীমা। প্রত্যাখ্যানের ক্ষেত্রে লিখিত ব্যাখ্যা দেয়া উচিত, যা দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি এবং আস্থা স্থাপন করবে। অনুমোদিত নাগরিক পর্যবেক্ষকরা তাদের নিরপেক্ষতা ও দলের প্রতি আনুগত্য নেই এটা নিশ্চিত করবেন যাতে পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম বিশ্বাসযোগ্য ও স্বতন্ত্র হয়। কমিশনকে অনুমোদিত পর্যবেক্ষক দলের সঙ্গে নিয়মিত ব্রিফিং আয়োজন করতে হবে, যাতে আপডেট শেয়ার করা যায়, উদ্বেগ সমাধান করা যায় এবং নির্বাচনের পূর্বে সেরা অনুশীলন পুনর্ব্যবহার করা যায়।
রাজনৈতিক তহবিলে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা : নির্বাচন কমিশনকে আইনি সংশোধনী প্রস্তাব করতে হবে, যা রাজনৈতিক তহবিল সংগ্রহ ও প্রচারণা ব্যয়ের তথ্য জনগণের জন্য উন্মুক্ত করবে। এই সংস্কার নাগরিক, মিডিয়া ও সমাজসেবামূলক সংস্থাগুলোকে অর্থ প্রবাহ পর্যবেক্ষণ এবং নির্বাচনি বিধি মেনে চলা যাচাই করতে সাহায্য করবে। অসংগতি বা ভুল রিপোর্টিংয়ের জন্য স্পষ্ট দণ্ডনীতি প্রণয়ন এবং প্রয়োগ করতে হবে। স্বতন্ত্র অডিট ও সমাজসেবা পর্যবেক্ষণ উৎসাহিত করা উচিত, যা দায়বদ্ধতা ও জনগণের আস্থা বৃদ্ধি করবে।
নির্বাচনের সময় স্বাধীন ও বিশ্বাসযোগ্য তথ্য পরিবেশ প্রচার করা : মিডিয়া সংস্থাগুলোকে পেশাগত মানদণ্ড রক্ষা করতে হবে, এবং নির্বাচনে পক্ষপাত এড়াতে হবে। সম্পাদকীয় স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে, এবং সাংবাদিকদের রাজনৈতিক বা আর্থিক চাপ থেকে মুক্ত থাকতে হবে। নাগরিক সমাজ ও নির্বাচন কমিশনকে ভোটার-শিক্ষা উদ্যোগে সহযোগিতা করতে হবে, যাতে ভোটাররা মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর তথ্য চিহ্নিত করতে পারে এবং অনলাইন আচরণের প্রভাব বোঝে।



























