ভুয়া তথ্যে সয়লাব অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, বাড়ছে বিভ্রান্তি

ডিজিটাল যুগে তথ্য পাওয়ার সহজলভ্যতা যেমন মানুষের জীবনকে সহজ করেছে, তেমনি ভুয়া ও বিভ্রান্তিকর তথ্য এখন বড় এক হুমকিতে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে ফেসবুক, ইউটিউব ও টিকটকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিদিন শত শত ভুয়া কনটেন্ট ছড়িয়ে পড়ছে।
কখনো পুরোনো ভিডিওর সঙ্গে নতুন অডিও জুড়ে দেওয়া হচ্ছে, কখনো সংবাদমাধ্যমের নাম নকল করে ভুয়া কার্ড তৈরি হচ্ছে, আবার কখনো তারকা বা রাজনৈতিক নেতাদের নামে ভুয়া ব্যাংক স্টেটমেন্ট ছড়ানো হচ্ছে।
এসবের উদ্দেশ্য একটাই—রাজনৈতিক উত্তেজনা ছড়ানো, তারকাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করা বা সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করা, ফ্যাক্টচেকিং ও রুমার স্ক্যানারের অনুসন্ধানে এমন তথ্যই উঠে এসেছে।
শেখ মুজিবকে স্মরণ, তারকাদের নামে গুজব ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫০তম মৃত্যুবার্ষিকীতে দেশের শোবিজ তারকারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শোকবার্তা দেন। কিন্তু পরক্ষণেই গুজব ছড়ানো হয়, তারা নাকি টাকার বিনিময়ে এসব পোস্ট করেছেন। একটি কথিত ব্যাংক স্টেটমেন্ট ভাইরাল হয়, যেখানে অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওনের নামে কয়েকজনকে টাকা পাঠানোর তথ্য দেওয়া হয়। ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা রিউমর স্ক্যানার বাংলাদেশ দ্রুতই প্রমাণ করে, স্টেটমেন্টটি ভুয়া এবং সেখানে উল্লেখিত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আদৌ নেই।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ভুয়া ভিডিও
রাজনীতিতে ভুয়া তথ্য ব্যবহারের প্রবণতা আরও বেশি। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও ছড়ানো হয়—কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) সদস্যরা নাকি বান্দরবানের রুমায় অস্ত্র হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পরে দেখা যায়, ভিডিওটি আসলে ফিলিপাইনের বিদ্রোহী সংগঠন মোরো ইসলামিক লিবারেশন ফ্রন্ট (এমআইএলএফ)-এর। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ভিডিওটি ছড়ানো হয় সজীব ওয়াজেদ জয়ের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকেও।
অন্যদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিবের বাড়ি থেকে টাকা ভর্তি বস্তা উদ্ধার হয়েছে—এমন খবরও ছড়ানো হয়। পরে নিশ্চিত হওয়া যায়, এটি ছিল পুরোনো এক মামলার ভিডিও, যেটি নতুন করে ব্যবহার করে রাজনৈতিক বিভ্রান্তি তৈরি করা হয়েছে।
সংবাদমাধ্যমের নাম ব্যবহার করে প্রতারণা
জনপ্রিয় অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধনের নামে একটি ভুয়া নিউজ কার্ড ছড়ানো হয়, যেখানে বলা হয় তিনি থাইল্যান্ডে চুরির দায়ে গ্রেপ্তার হয়ে জরিমানা দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন। নিউজ কার্ডটি বানানো হয়েছিল আরটিভির লোগো ও ডিজাইন নকল করে। আরটিভি দ্রুতই জানায়, তারা কখনোই এমন খবর প্রকাশ করেনি।
প্রতারণায় সাধারণ মানুষও
ভুয়া তথ্য শুধু রাজনীতি বা বিনোদনকেন্দ্রিক নয়, সাধারণ মানুষকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ফেসবুকে ভুয়া পেজ থেকে পণ্য বিক্রির নামে প্রতারণার ঘটনা বেড়েছে। ঢাকার ঝিগাতলার এক শিক্ষার্থী জানান, তিনি ৩,৫০০ টাকা দিয়ে পাকিস্তানি ড্রেস অর্ডার করেছিলেন। টাকা দেওয়ার পর দেখেন, পেজটি উধাও হয়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন
গবেষকরা বলছেন, ভুয়া তথ্য এখন শুধু ব্যক্তির মানহানি বা অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হচ্ছে না, এটি সমাজে উত্তেজনা সৃষ্টি করছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দুর্বল করার জন্য ভুয়া ভিডিও বা ছবি ব্যবহার করা হচ্ছে। আবার জনপ্রিয় তারকাদের মানসম্মান নষ্ট করতেও এ ধরনের কনটেন্ট ব্যবহৃত হচ্ছে। সাধারণ মানুষ প্রতারিত হচ্ছে অনলাইন কেনাকাটার নামে।
তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধার সঙ্গে ভুয়া তথ্যের এই হুমকি যেন বেড়েই চলেছে। সময়মতো ব্যবস্থা না নিলে এটি দেশের সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় সংকটে পরিণত হতে পারে।
সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ তানভীর জোহা বলেন, “এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই দিয়ে এমন ভিডিও তৈরি করা যায়, যা আসল না নকল তা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা প্রায় অসম্ভব। ফলে মানুষ খুব সহজেই প্রতারিত হচ্ছে।”
তিনি পরামর্শ দেন, “সরকার চাইলে একটি কেন্দ্রীয় ফ্যাক্টচেকিং ইউনিট গঠন করতে পারে। অনেক দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে ভুয়া তথ্য যাচাই করার জন্য সরকারি ওয়েব পোর্টাল চালু আছে। আমাদের দেশেও এমন ব্যবস্থা করা গেলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নজরদারি জোরদার হবে। একই সঙ্গে যারা ইচ্ছাকৃতভাবে গুজব ছড়ায়, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নিতে হবে।"