ইন্দোনেশিয়ায় সহিংস বিক্ষোভ
এমপি-মন্ত্রীদের বাড়িতে হামলা, উঠছে “এশিয়ান স্প্রিং”-এর আভাস

ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাসে নজিরবিহীনভাবে সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের ব্যক্তিগত বাসভবনে হামলা ও লুটপাট চালিয়েছে ক্ষুব্ধ জনতা। বিলাসী ভাতা ও বিশেষ সুবিধা নিয়ে শুরু হওয়া ক্ষোভ এখন রূপ নিয়েছে সহিংসতায়, যা ছড়িয়ে পড়েছে রাজধানী জাকার্তা থেকে শুরু করে সুরাবায়া, মাকাসার, বানদুং ও মেডানসহ দেশের প্রধান প্রধান শহরে। সরকারি অফিস, প্রশাসনিক ভবন, এমনকি জনপ্রতিনিধিদের ব্যক্তিগত বাড়িঘরও বিক্ষোভকারীদের আক্রমণের শিকার হয়েছে।
এই আন্দোলনের সূচনায় রয়েছে এমপি ও সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য নির্ধারিত বিলাসবহুল ভাতা। যখন দেশের সাধারণ মানুষ মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে টিকে থাকার লড়াই করছে, তখন এমপিদের জন্য অতিরিক্ত বাড়ি ভাড়া, পরিবহন সুবিধা, বিদেশ সফরের বাজেট ও বিনোদনের খরচ জনগণের কাছে বৈষম্যের প্রতীক হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষের ভাষায়, তাদের প্রতিনিধিরা জনগণের দুঃখ-দুর্দশার সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেলেছেন। শ্রমিক সংগঠনগুলোর নেতারা বলেছেন, দিনে আঠারো ঘণ্টা কাজ করেও শ্রমিকরা পরিবার চালাতে হিমশিম খায়, অথচ এমপিরা কোটি কোটি রুপিয়াহ বিলাসিতায় ব্যয় করছেন।
সহিংসতা শুরু হওয়ার পর থেকে অন্তত সাতজন নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন পুলিশ, বিক্ষোভকারী ও সাধারণ মানুষ। আহত হয়েছেন চার শতাধিক মানুষ। সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ঘটে জাকার্তায়, যেখানে ২১ বছর বয়সী এক খাবার সরবরাহকর্মী বিক্ষোভ শেষে ফেরার পথে পুলিশের সাঁজোয়া গাড়ির চাপায় নিহত হন। এ মৃত্যু ক্ষোভে ফেটে পড়া আন্দোলনকে আরও জোরালো করে তোলে। এরপর বিক্ষোভকারীরা অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করতে শুরু করে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ লাঠিচার্জ, জলকামান ও রাবার বুলেট ব্যবহার করে। শত শত মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো অভিযোগ করেছে, পুলিশের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগে শান্তিপূর্ণ মিছিলগুলোও সহিংসতায় রূপ নিয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অনেক ক্ষেত্রে অকারণে নিরীহ মানুষকে টার্গেট করেছে।
প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো এক টেলিভিশন ভাষণে জনগণকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সরকারি ভাতা ও বিশেষ সুবিধা নিয়ে সরকারের নীতিমালা পুনর্বিবেচনা করা হবে। তবে তিনি একই সঙ্গে সহিংস বিক্ষোভ থেকে বিরত থাকারও অনুরোধ জানান।
এই আন্দোলনের নেতৃত্বে রয়েছেন যুবসমাজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শ্রমিকরা। ছাত্র সংগঠনগুলো দাবি তুলেছে, ভাতা সংস্কারের পাশাপাশি বৃহত্তর রাজনৈতিক সংস্কার দরকার। শ্রমিক ইউনিয়নগুলো মনে করছে, এ আন্দোলন শুধু ভাতার বিষয় নয়, বরং অর্থনৈতিক বৈষম্য ও সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটি বিদ্রোহ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ইন্দোনেশিয়ার এ বিক্ষোভকে আরব বসন্তের (Arab Spring) সঙ্গে তুলনা করা যায়। ২০১১ সালে মধ্যপ্রাচ্যে যে গণআন্দোলন শুরু হয়েছিল, তার মতোই ইন্দোনেশিয়ায় দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ফেটে পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এর সূত্রপাত হয়েছে ২০২০ সালের ওমনিবাস আইন থেকে, যা শ্রমিকদের অধিকার সংকুচিত করেছিল এবং যার ফলে সারা দেশে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছিল। এর পর থেকে জনগণের মধ্যে ক্ষোভ জমতে থাকে। মহামারী-পরবর্তী অর্থনৈতিক সংকট, বাড়তি বেকারত্ব ও ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তোলে। ফলে অনেকেই বলছেন, ইন্দোনেশিয়া হয়তো এখন একটি “এশিয়ান স্প্রিং”-এর দ্বারপ্রান্তে।
আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মহলেও এ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। আসিয়ান দেশগুলো আশঙ্কা করছে, ইন্দোনেশিয়ার অস্থিরতা পুরো অঞ্চলে প্রভাব ফেলতে পারে। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন পুলিশের অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের সমালোচনা করেছে এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে। আন্তর্জাতিক মহল মনে করছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র হিসেবে ইন্দোনেশিয়ার স্থিতিশীলতা আঞ্চলিক রাজনীতি ও অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ভবিষ্যতে পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে, তা নির্ভর করছে সরকারের পদক্ষেপের ওপর। যদি সরকার দ্রুত ভাতা কমানো, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ও জনগণের জন্য সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার মতো সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেয়, তবে শান্তি ফিরতে পারে। কিন্তু দমননীতি অব্যাহত থাকলে সহিংসতা আরও বাড়বে এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। একজন রাজনৈতিক গবেষক মন্তব্য করেছেন, “ইন্দোনেশিয়া আজ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। সরকার যদি জনগণের সঙ্গে আস্থা পুনর্গঠন করতে না পারে, তবে দেশটি হয়তো সত্যিই একটি এশিয়ান স্প্রিং-এর সাক্ষী হতে চলেছে।”
সব মিলিয়ে বলা যায়, ইন্দোনেশিয়ার সাম্প্রতিক সহিংস বিক্ষোভ কেবল ভাতা ইস্যু নয়, বরং গভীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রতিফলন। জনগণ এক কণ্ঠে বলছে—জনপ্রতিনিধিরা নিজেদের বিলাসিতা নয়, বরং জনগণের স্বার্থে কাজ করুক। আর ইতিহাস হয়তো একদিন এই আন্দোলনকেই গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হিসেবে মনে রাখবে।