ঢাকায় ৩৮টির বেশি মাদক হটস্পট
ঢাকা— উন্নয়ন, বাণিজ্য ও আধুনিকায়নের উজ্জ্বল আলোয় ব্যস্ত রাজধানীর ভেতরেই নির্বিঘ্নে বিস্তার করছে মাদক সিন্ডিকেট। গোয়েন্দা ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর–এর তথ্যমতে, শহরে ৩৮টিরও বেশি সক্রিয় মাদক হটস্পট রয়েছে। এর বেশিরভাগই বস্তি ও বিহারী ক্যাম্প এলাকায় অবস্থান নিয়ে রাজধানীকে রূপ দিচ্ছে ‘ছায়া মাদকরাজ্যে’।
মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, রাজধানীতে মাদক ব্যবসা এখন আইন নয়, বরং সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত এক সমান্তরাল ব্যবস্থা। ঘনবসতিপূর্ণ বস্তি ও ক্যাম্প এলাকার সংকীর্ণ গলি, অস্থায়ী গুদাম ও স্থানীয় আধিপত্য গোষ্ঠীর ছত্রচ্ছায়ায় এই চক্রগুলো নির্বিঘ্নে নেটওয়ার্ক চালিয়ে যাচ্ছে।
গত তিন বছরে ঝুঁকিপূর্ণ মাদক জোন হিসেবে যেসব এলাকা বারবার উঠে এসেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কড়াইল বস্তি, জেনেভা ক্যাম্প, মিরপুরের বিহারী পট্টি, রূপনগরের বস্তি বেল্ট, মোহাম্মদপুর–শেরেবাংলা এলাকা, কামরাঙ্গীরচর, কল্যাণপুর, মুগদা–মানিকনগর ও হাজারীবাগ ক্যাম্প অঞ্চল।
ডিএনসির জনসংযোগ কর্মকর্তা মোস্তাক আহমেদ বলেন, “আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। এবং নতুন নতুন স্থান সনাক্ত করার চেষ্টা করছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা ডিএমপি–র বরাতে জানান, “হটস্পট মানে ধরা পড়া জায়গা। কিন্তু যেগুলো আড়ালে আছে বা প্রবেশ রোধ করা যায়—তার সংখ্যা আরও বেশি। কিছু এলাকায় এখনো আমরা ঢুকতেই পারি না।”
নিরাপত্তা ও অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, মাদক চক্র রাজধানীকে কেন্দ্র করে ৫ স্তরের পেশাদার কাঠামোতে কাজ করছে, আমদানিকারক ও পাইকার আন্তর্জাতিক ও সীমান্ত রুট ব্যবহার করে ইয়াবা, আইস, হেরোইন ও বিদেশি মদ ঢাকায় প্রবেশ করায়। এরপর বস্তি–ভিত্তিক গুদামদাররা কড়াইল, জেনেভা, রূপনগর ও কল্যাণপুরে তা সংরক্ষণ করে। স্পট লিডার ও স্পট বয়রা প্রতিটি পয়েন্টে ৮–২০ জনের দলে দৈনিক বেচাকেনা চালায়। এলাকাভেদে দিনে ১,০০০–৫,০০০ পিস পর্যন্ত লেনদেন হয়। এরপর মোটরবাইক ও ডেলিভারি টিম রাইড–শেয়ারিং কিংবা কুরিয়ারের আড়ালে গুলশান, উত্তরা ও বসুন্ধরা এলাকায় মাদক পৌঁছে দেয়। সবশেষে গ্রাহক সংযোগকারীরা ছাত্র, বেকার যুবক ও চাকুরিজীবীদের মধ্যে এই নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে দেয়।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, মাদক বেচাকেনা এখন ডিজিটাল মাধ্যমে কভার শব্দ, কোড মেসেজ ও গোপন গ্রুপে যোগাযোগের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। অনেক লেনদেন হয় টেলিগ্রাম–এর মতো এনক্রিপ্টেড অ্যাপ ব্যবহার করে। ফলে অভিযান চালানো গেলেও প্রমাণ বা তথ্য সংগ্রহ আগের তুলনায় আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।
বস্তি–ক্যাম্পের মাদক স্পটগুলোতে এখন মাদকের পাশাপাশি অস্ত্রের ব্যবহার, ছিনতাই, অস্ত্র ভাড়া, নারী পাচার ও দেহব্যবসা নেটওয়ার্কও সক্রিয়।
সমাজবিজ্ঞানী মাহমুদা সুলতানা বলেন, “মাদক অপরাধের জ্বালানি। যেখানে মাদক কেন্দ্র গড়ে ওঠে, সেখানে অন্য অপরাধও স্বাভাবিকভাবেই জন্ম নেয়।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু অভিযান দিয়ে ঢাকা শহরের এই ছায়া সাম্রাজ্য নির্মূল সম্ভব নয়। তারা দীর্ঘমেয়াদি চারটি কৌশলের কথা বলেন, কমিউনিটি পুলিশিং শক্তিশালী করা, মাদক চক্রের অর্থের উৎস খুঁজে মানি ট্রেইল তদন্ত চালানো, কিশোর–যুবকদের পুনর্বাসনে ক্রীড়া, শিক্ষা ও সামাজিক উদ্যোগ বাড়ানো, বস্তি অঞ্চলের আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা।
অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, “সমন্বিত কৌশল, আর্থিক তদন্ত ও কমিউনিটি উদ্যোগ ঐসব এলাকাকে পরিষ্কার করার একমাত্র বাস্তব সমাধান।”
ঢাকাজুড়ে ৩৮টির বেশি মাদক হটস্পট কেবল একটি পরিসংখ্যান নয়, এটি রাজধানীর নিরাপত্তার ওপর সরাসরি হুমকি। যদি বড় নেটওয়ার্ক, অর্থের উৎস ও পৃষ্ঠপোষকদের বিরুদ্ধে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হয়, তবে একদিন আইন থাকবে, কিন্তু কার্যকর নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে সিন্ডিকেটের হাতে।



























