বৃহস্পতিবার ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ১৫ কার্তিক ১৪৩২

সংবাদ পরিক্রমা ডেস্ক

প্রকাশিত: ১১:১০, ৩০ অক্টোবর ২০২৫

৫৬ বছর বয়সে এইচএসসি পাস করলেন শাম্মী আক্তার

৫৬ বছর বয়সে এইচএসসি পাস করলেন শাম্মী আক্তার
ছবি: সংগৃহীত

খুলনার শাম্মী আক্তারের জীবনী প্রমাণ করে, কখনোই দেরি হয় না স্বপ্ন পূরণের জন্য। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরও তিনি থেমে যাননি। সংসার, সন্তান, দায়িত্ব—সব কিছু সামলাতে গিয়ে নিজের পড়াশোনার স্বপ্নকে জীবন্ত রেখেছেন। আজ ৫৬ বছর বয়সে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৩.১৮ নিয়ে পাশ করে শাম্মী দেখিয়েছেন, ইচ্ছাশক্তিই হলো কোনো বাধা অতিক্রমের আসল শক্তি।

বেগম রোকেয়ার কালজয়ী বাণী ‘নারীশিক্ষা মানেই জাতির অগ্রগতি’ যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে শাম্মীর সাফল্যে। যেখানে অনেকের কাছে বয়স একটি বাধা, সেখানে তিনি প্রমাণ করেছেন—ইচ্ছাশক্তির সামনে বয়স কেবল একটি সংখ্যা।

শাম্মী আক্তার ১৯৮৮ সালে দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় বিয়ে হয়। সংসার, সন্তান ও দায়িত্বের পাহাড় তখন তার পড়াশোনা থেমে দেয়। কিন্তু তিনি থেমে থাকেননি। সন্তানদের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি নিজের শিক্ষার স্বপ্নও অটুট রেখেছিলেন। মনের জোর, পরিবারের সমর্থন এবং অদম্য ইচ্ছাশক্তির মিলনেই ৫৬ বছর বয়সে আবারও পরীক্ষার হলে বসেন তিনি। ফলাফল ছিল গর্বের—খুলনার মজিদ মেমোরিয়াল সিটি কলেজ থেকে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৩.১৮ নিয়ে পাশ করেন শাম্মী আক্তার।

নতুন করে পড়াশোনা শুরু করা মোটেও সহজ ছিল না। ২০১৯ সালে ছেলে ও স্বামীর উৎসাহে আবারও পড়াশোনার আগ্রহ জাগে তার মনে। খুলনার ইকবাল নগর বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও কোর্স বন্ধ হয়ে যায়, এরপর বদলি প্রতিষ্ঠান থেকেও ভর্তি বাতিলের সংবাদ পান। একপর্যায়ে ভেঙে পড়েছিলেন, মনে হয়েছিল—হয়তো আর সম্ভব নয়।

তবু ২০২১ সালে এক শিক্ষকের খুদে বার্তা তার আশার প্রদীপ জ্বেলে দেয়। কাউকে না জানিয়ে লুকিয়ে ভর্তি হন, নিজের টাকায় বই কিনে আনেন। প্রথম দিন বাড়িতে বই নিয়ে আসা ছিল গোপন। পরে স্বামী ও সন্তানকে জানিয়ে নিয়মিতভাবে পড়াশোনা শুরু করেন। প্রতি শুক্রবার ক্লাসে যেতেন, কোচিং করতেন। প্রতিদিন বাড়ির সব কাজ শেষ করে, নামাজ শেষে রাত জেগে পড়তেন—অনেক সময় ভোর ৩টা পর্যন্ত।

শাম্মী আক্তার বলেন, “প্রতিদিনের পরিশ্রম আর ধৈর্যই আমাকে আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছে। কখনো হাল ছাড়িনি। যতদিন সুস্থ থাকব, পড়াশোনা চালিয়ে যাব। এবার অনার্সে ভর্তি হব।”

তার স্বামী মো. হাফিজুর রহমান মোল্লা, অবসরপ্রাপ্ত সেনা সার্জেন্ট, স্ত্রীকে পাশে থেকে সব সময় সমর্থন দিয়েছেন। তিনি বলেন, “রাত ১১টার দিকে বাসায় এসে দেখতাম, শাম্মী বই নিয়ে বসে আছে। চা বানিয়ে রাখলেও ঠান্ডা হয়ে যেত, কারণ ও মনোযোগ দিয়ে পড়ত। কখনো জামা-কাপড় ধোয়া বা আয়রন করতে দেইনি। ওর স্বপ্ন পূরণে সব সময় পাশে ছিলাম।”

শাম্মীর বড় ছেলে মো. মামুনুর রশীদ খুলনার আযম খান সরকারি কমার্স কলেজ থেকে মার্কেটিংয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষে বর্তমানে নোয়াখালীর একটি মহিলা কলেজের প্রভাষক। ছোট ছেলে এম এম আবদুল্লাহ আল মামুন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর শেষ করে হাঙ্গেরিতে পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন।

শাম্মী আক্তারের জন্ম ১৯৬৯ সালে নড়াইল জেলায়। বাবা কাজী জাহিদুর রহমান সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি মেজ। ছোটবেলায় সংসারের টানাপোড়েনের কারণে দশম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বিয়ে হয় তার। ২০২৩ সালে এসএসসি পরীক্ষায় পাশ করার পরই প্রয়াত মা সবচেয়ে খুশি হতেন। এবার এইচএসসি পরীক্ষার ফল হাতে নিয়ে মায়ের নম্বরে কল দিতে গিয়ে মনে পড়ে যায়, মা আর নেই। শাম্মীর কণ্ঠ কেঁপে ওঠে, “মা থাকলে খুব খুশি হতেন।”

বর্তমানে শাম্মী শুধু নিজের স্বপ্ন পূরণেই সীমাবদ্ধ নন, তিনি সমাজের নারীদেরও এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করতে চান। পড়াশোনার পাশাপাশি উদ্যোক্তা হয়ে বেকারত্ব দূর করার কাজও করছেন। ইতিমধ্যেই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বাড়িতেই একটি ছোট ব্যবসা শুরু করেছেন।

খুলনার করিমনগরের শাম্মী আক্তার প্রমাণ করেছেন—শিক্ষার কোনো শেষ নেই। ৫৬ বছর বয়সে এইচএসসি পাস করে তিনি দেখিয়েছেন, বয়স নয়, ইচ্ছাশক্তিই আসল শক্তি।

জনপ্রিয়