পেঁয়াজ আমদানিতেও চক্রের দ্বিগুণ মুনাফা
মুড়িকাটা পেঁয়াজের মৌসুম শুরু হতেই কয়েক বছর লোকসানের ক্ষত পুষিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন কৃষকেরা। কিন্তু ঠিক এই সময়েই অস্থির হয়ে উঠেছে পেঁয়াজের বাজার। পর্যাপ্ত উৎপাদন ও মজুত থাকার পরও হঠাৎ দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে—এই অস্থিরতার পেছনে আসল কারণ কী? বাজার-সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, আমদানিকারক ও পাইকারি পর্যায়ের একটি শক্তিশালী চক্র সংকট তৈরি করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখনও আগের মৌসুমের প্রায় এক লাখ টন পেঁয়াজ মজুত রয়েছে। পাশাপাশি নতুন মৌসুমের পেঁয়াজও বাজারে আসতে শুরু করেছে। সব মিলিয়ে সরবরাহ পরিস্থিতি স্বস্তিদায়ক থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভারত থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ কেজিপ্রতি সব খরচ মিলিয়ে দেশে আসছে প্রায় ৫০ টাকায়। অথচ সেই পেঁয়াজই খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১৩০ টাকা দরে। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ও ঢাকার বিভিন্ন পাইকারি বাজারে অভিযান চালিয়ে আমদানিমূল্য ও বিক্রয়মূল্যের মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্যের তথ্য পেয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। সংস্থাটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, অনিয়ম প্রমাণিত হলে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, পর্যাপ্ত মজুত থাকার পরও কৃত্রিমভাবে পেঁয়াজের দাম বাড়ানো হয়েছে। কৃষকের স্বার্থ উপেক্ষা করে একটি অদৃশ্য শক্তির চাপে সরকার আমদানির অনুমতি দিতে বাধ্য হয়েছে। তাঁর মতে, আমদানিকারকরা কোন দামে পেঁয়াজ আনছেন এবং কোন দামে বিক্রি করছেন—এই তথ্য প্রকাশ করলেই বাজার অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার আমদানির অনুমতির সংখ্যা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সোম ও মঙ্গলবার দিনে ৫৭৫টি করে আমদানি অনুমতি (আইপি) ইস্যু করা হয়েছে। প্রতিটি আইপির বিপরীতে সর্বোচ্চ ৩০ টন পেঁয়াজ আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহে ভারত থেকে ১৯ হাজার ৫০০ টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এর আগে প্রতিদিন মাত্র ৫০টি আইপি ইস্যু করা হলেও বাজারে দাম না কমায় আমদানির পরিমাণ বাড়ানো হয়।
কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, বাস্তবে দেশে পেঁয়াজের কোনো ঘাটতি নেই। দেশে মোট উৎপাদন প্রায় ৪৪ লাখ টন, যেখানে বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২৮ লাখ টন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আগেই ঘোষণা দিয়েছিল, পেঁয়াজের দাম ১৫০ টাকা অতিক্রম করলে আমদানির অনুমতি দেওয়া হবে। এই সুযোগ নিতে একটি চক্র ইচ্ছাকৃতভাবে দাম বাড়িয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে বলে অভিযোগ তাঁদের।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন উইংয়ের অতিরিক্ত পরিচালক (মনিটরিং ও বাস্তবায়ন) ড. মো. জামাল উদ্দীন বলেন, আমদানির অনুমতি আদায়ের জন্য একটি চক্র ইচ্ছা করেই সংকট তৈরি করছে। দেশের বিভিন্ন গুদামে এখনও এক লাখ টনের বেশি পেঁয়াজ মজুত রয়েছে।
তিনি আরও জানান, গত বছর প্রায় চার লাখ টন এবং তার আগের বছর সাড়ে সাত লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছিল। এবার উৎপাদন ভালো হওয়ায় এখন পর্যন্ত মাত্র ১২ হাজার ৯০০ টন আমদানি হয়েছে। সংরক্ষণ সুবিধা বাড়ানো গেলে দেশে উৎপাদন আরও স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হবে।
বাজার-সংশ্লিষ্টদের মতে, আমদানির অনুমতি পেলেও ভোক্তারা এর সুফল পাচ্ছেন না। লাভের বড় অংশ যাচ্ছে আমদানিকারকদের পকেটে। কারওয়ান বাজারের আড়তদারদের ভাষ্য, নতুন পেঁয়াজ পুরোপুরি বাজারে এলে দাম কেজিতে ১০০ টাকার নিচে নামার কথা। কিন্তু এর আগেই যদি অতিরিক্ত আমদানির চাপ দেওয়া হয়, তাহলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন দেশের কৃষকেরা।
এদিকে দামের চাপে রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় পাতাসহ অপরিপক্ব পেঁয়াজ বিক্রি হতে দেখা যাচ্ছে। বেশি দামের আশায় অনেক কৃষক পেঁয়াজ পুরোপুরি পরিপক্ব হওয়ার আগেই জমি থেকে তুলে ফেলছেন। কৃষি কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন, এতে সামনে প্রকৃত সংকট তৈরি হতে পারে। কারণ অপরিপক্ব পেঁয়াজের ওজন কম হয় এবং তা দীর্ঘদিন সংরক্ষণযোগ্য নয়।
পেঁয়াজের ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বায়া গ্রামের কৃষক মাহফুজুর রহমান জানান, তাঁর পেঁয়াজ পরিপক্ব হতে এখনও দুই সপ্তাহ সময় লাগার কথা। কিন্তু এখন বাজারে ভালো দাম পাওয়ার আশায় তিনি অপেক্ষা করছেন না। তাঁর মতো সাঁথিয়ার অনেক কৃষকই বেশি দামের লোভে অপরিপক্ব মুড়িকাটা পেঁয়াজ বাজারে ছাড়ছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এস এম সোহরাব উদ্দিন বলেন, অক্টোবরের শুরুতে খুব অল্প জমিতে যে মুড়িকাটা পেঁয়াজ আবাদ হয়েছিল, সেগুলোই এখন পরিপক্ব হয়েছে। কিন্তু ভালো দাম দেখে কৃষকেরা কিছুটা অপরিপক্ব পেঁয়াজও তুলে ফেলছেন, এতে মোট উৎপাদন কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা কৃষকদের সচেতন করার চেষ্টা করছেন।
কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, পেঁয়াজের বাজার স্থিতিশীল রাখতেই আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মোট চাহিদার তুলনায় খুবই সামান্য—প্রায় ৫০ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এতে কৃষকের ক্ষতি হবে না। ইতোমধ্যে দাম কমতে শুরু করেছে এবং আশা করা হচ্ছে, সামনে আর আমদানির প্রয়োজন পড়বে না।
সূত্র: সমকাল



























