জামায়াতের দ্বিমুখী আচরণ: আত্মসমালোচনা নাকি কৌশলগত পুনর্বাসন?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামী সবসময়ই একটি বিতর্কিত নাম। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা, পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতা এবং পরবর্তীকালে সেই ভূমিকা অস্বীকারের প্রবণতা দলটির ইতিহাসে গভীর ছাপ রেখে গেছে। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও তারা এই ইতিহাসের দায় থেকে মুক্ত হতে পারেনি। সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে আবারও সেই পুরোনো প্রশ্ন সামনে এসেছে—জামায়াত কি সত্যিই পরিবর্তিত হচ্ছে, নাকি এটি কেবলই রাজনৈতিক কৌশলের অংশ?
সম্প্রতি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক মাসুদ এক অনুষ্ঠানে বলেন, “১৯৭১ ছিল ভারতের ষড়যন্ত্রমূলক স্বাধীনতা।” এই মন্তব্য শুধু মুক্তিযুদ্ধের মর্যাদা নয়, বাংলাদেশের অস্তিত্বের ভিত্তিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, কিছুদিন পরই জামায়াতে ইসলামী আমির ১৯৭১ সালের ঘটনার জন্য জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তিনি বলেন, “আমরা সেই সময়ের কর্মকাণ্ডে দুঃখ প্রকাশ করছি।”
একই দলের দুই বিপরীত বক্তব্য—একদিকে ক্ষমা প্রার্থনা, অন্যদিকে ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব—জামায়াতের ভেতরের মানসিক বিভাজনকেই প্রকাশ করে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের রাজনৈতিক মিত্র হিসেবে কাজ করেছিল। তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতারা আলবদর ও আলশামস বাহিনীতে যুক্ত হয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধে অংশ নেয়। যুদ্ধ শেষে দলটি নিষিদ্ধ হয়, কিন্তু সামরিক শাসনের সময় আবার রাজনৈতিক মাঠে ফেরার সুযোগ পায়। ১৯৯১ সালে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর থেকে তারা মূলধারার রাজনীতিতে অংশ নিতে শুরু করে—কখনো বিএনপির সহযোগী দল হিসেবে, কখনো স্বতন্ত্র সংগঠন হিসেবে।
তবে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অতীত কখনোই পুরোপুরি মুছে যায়নি। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে দলটির শীর্ষ নেতাদের বিচার ও মৃত্যুদণ্ডের পর জনমনে জামায়াতের ভাবমূর্তি আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর পর থেকেই তারা নিজেদের পুনর্গঠনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে—“নতুন প্রজন্মের জামায়াত” হিসেবে আত্মপ্রকাশের প্রয়াস দেখা যায়। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা বারবার ব্যাহত হচ্ছে দলের অভ্যন্তরীণ মতাদর্শগত বিভাজনে।
পি.আর. পদ্ধতি ব্যতীত জুলাই সনদের বিষয়ে দলটি স্পষ্টভাবে জানায়, তারা এতে স্বাক্ষর করবে না। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই একই দল আগেভাগে গিয়ে সেই সনদে স্বাক্ষর করে। এই পরিবর্তন অনেককে বিস্মিত করেছে। একদিকে নীতিগত অবস্থান থেকে বিরত থাকা, অন্যদিকে হঠাৎ করে অংশগ্রহণ—এটি কি মতাদর্শগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত, নাকি রাজনৈতিক সুযোগের সদ্ব্যবহার?
একই রকম দ্বিধা দেখা গেছে বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতির ক্ষেত্রেও। সম্ভাব্য জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে জামায়াতের আচরণে কিছুটা নমনীয়তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তারা এখন সরাসরি “ইসলামী রাষ্ট্র” প্রতিষ্ঠার ভাষা পরিহার করে “জনগণের অধিকার” ও “গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার” ইত্যাদি ভাষা ব্যবহার করছে। এটি স্পষ্টতই মূলধারার রাজনীতিতে টিকে থাকার কৌশল, কারণ ধর্মীয় রাষ্ট্রের আদর্শ এখন তরুণ ভোটারদের কাছে আকর্ষণীয় নয়।
জামায়াত যদি সত্যিই আত্মসমালোচনায় বিশ্বাস করত, তবে তাদের প্রথম পদক্ষেপ হতো মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার দায় স্বীকার করা এবং যুদ্ধাপরাধে জড়িতদের কর্মকাণ্ডের জন্য আনুষ্ঠানিক অনুতাপ প্রকাশ করা। কিন্তু দলটির ভেতরের নেতৃত্ব এখনো সেই ঐতিহাসিক সত্যকে পুরোপুরি মেনে নিতে পারছে না। একদিকে ক্ষমা প্রার্থনা করে জনমত কোমল করার চেষ্টা, অন্যদিকে স্বাধীনতাকে বিদেশি ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করা—এটি আত্মসমালোচনা নয়, বরং রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা মাত্র।
তরুণ প্রজন্মের কাছে ইতিহাসের সত্য আর লুকানো নেই। তারা জানে কে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল, কে বিপক্ষে। জামায়াতের মতো দলগুলো যখন ইতিহাস বিকৃত করে, তখন তা কেবল তাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াতাকেই প্রকাশ করে।
জামায়াত যদি সত্যিই বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় নতুন করে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে চায়, তবে তাদের সামনে একটাই পথ খোলা—স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি প্রকাশ্য শ্রদ্ধা ও দায় স্বীকার। তাদের উচিত হবে যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিত নেতাদের প্রশংসা বন্ধ করা, ধর্মীয় উগ্রতার রাজনীতি পরিহার করা এবং গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নে সুস্পষ্ট অবস্থান নেওয়া।
বাংলাদেশের রাজনীতি আজ পরিণত হচ্ছে; জনগণ এখন কেবল ধর্মীয় আবেগ নয়, উন্নয়ন, মানবাধিকার ও ন্যায়ের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে চায়। এই বাস্তবতায় জামায়াতের দ্বিমুখী আচরণ তাদের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক অবস্থানকে আরও দুর্বল করে তুলছে।
অতএব, প্রশ্ন এখনো রয়ে যায়—জামায়াতের এই ক্ষমা প্রার্থনা কি সত্যিকারের আত্মসমালোচনার প্রতিফলন, নাকি আসন্ন নির্বাচনে নিজেদের প্রাসঙ্গিক রাখার একটি কৌশলগত অভিনয়? ইতিহাসের দায় থেকে পালানো যায় না; বরং সেই দায় স্বীকার করলেই শুরু হয় প্রকৃত পরিবর্তনের পথ।



























