কমপ্লিট শাটডাউন, ইনকমপ্লিট নিরাপত্তা: রক্তের দামে লেখা ১৮ জুলাই

১৮ জুলাই ২০২৪। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে আরেকটি রক্তাক্ত মোড়। কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ঘোষিত হয় ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি। শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের প্রতিবাদ আর বঞ্চনার ইতিহাস একত্রে বিস্ফোরণ ঘটায় এদিন। ঢাকা থেকে খুলনা, চট্টগ্রাম থেকে রাজশাহী – কোনো শহর বাদ যায়নি আগুনের লেলিহান শিখা, টিয়ার শেল, লাঠিচার্জ ও রক্তের ছিটায়।
এই দিনটি শুধু একটি ছাত্রআন্দোলনের প্রতীক নয়, এটি এক জাতিগত স্তব্ধতার দিন – যে দিন রাজপথে নামে হাজারো মানুষ, কিন্তু তাদের আওয়াজ পৌঁছায় না কোথাও। কারণ, ১৮ জুলাই সকাল থেকেই বন্ধ করে দেওয়া হয় দেশের সমস্ত ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট। এর আগের দিন, অর্থাৎ ১৭ জুলাই রাত থেকেই মোবাইল ইন্টারনেট ছিল বন্ধ। ফলে একপ্রকার ব্ল্যাকআউট পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় – মানুষ দেখছিল, ভুগছিল, কিন্তু জানাতে পারছিল না।
সাধারণ জনগণ, সাংবাদিক, চিকিৎসক, এমনকি অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভারও জানতো না কোথায় সংঘর্ষ হচ্ছে, কোথায় রাস্তা বন্ধ, কোথায় কারা আহত। বিভ্রান্তি, গুজব ও ভয়ের এক আশ্চর্য মিশ্রণে ঢাকা পড়ে গোটা জাতি।
রাজপথে যারা ছিলেন, তারা জানেন সেই দিনের নৃশংসতা কেমন ছিল। আমি নিজেও একজন নারী কর্মী হিসেবে মাঠে ছিলাম সেদিন। লাঠিচার্জ, টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড – একের পর এক যেন মৃত্যু আর আতঙ্কের প্রতীক হয়ে মাথার ওপর ভেসে বেড়াচ্ছিল। শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচি হঠাৎই পরিণত হয় রণক্ষেত্রে।
আমার চোখের সামনে কয়েকজন শিক্ষার্থী রাবার বুলেটের আঘাতে লুটিয়ে পড়ে। একজনের পিঠে সজোরে লাঠি পড়ে, সে ছিটকে পড়ে সড়কে। আরেকজন নারী শিক্ষার্থীকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়, সেই দৃশ্য আমি আজও ভুলতে পারিনি।
একটি ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মধ্যে আমি পড়ে যায় । হঠাৎ বিস্ফোরণের শব্দ – সাউন্ড গ্রেনেড। কানে তালা লেগে যায় মুহূর্তেই। দিশেহারা হয়ে পড়ি। চোখে পানি, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে টিয়ার শেলের ধোঁয়ায়। চিৎকার, কান্না আর দৌড়াদৌড়ির মধ্যে কেউ একজন আমার ঘাড়ে ধাক্কা দেয়। আমি পড়ে যাই। আবার উঠে দাঁড়ানোর আগেই আঘাত আসে মাথা , হাতে, পায়ে-উরুতে সেই যন্ত্রণায় পুরো শরীরটা অবশ হয়ে গিয়েছিল।
এরপর আমি দেখি, আশেপাশে অনেকেই নিজ নিজ মোবাইল দিয়ে ভিডিও করতে চাইছিল। কিন্তু তখন ইন্টারনেট না থাকায় কেউ লাইভ করতে পারছিল না, কেউ হেল্প চাইতে পারছিল না। আহতদের ছবি বা ভিডিও ছড়ায়নি। সংবাদমাধ্যমও ছিল বাধাগ্রস্ত, কারণ সাংবাদিকদের ক্যামেরা ভেঙে ফেলা হয় একাধিক জায়গায়।
যখন চারপাশে আগুন জ্বলছে, যখন রাজপথ রক্তে রঞ্জিত – তখন কেউ নিজের অবস্থান জানাতে পারে না, পরিবারকে জানাতে পারে না, এমনকি কেউ কোথাও মারা গেলে সেটিও দেরিতে পৌঁছায় গণমাধ্যমে, পরিবারের কাছে।
এই ইন্টারনেটবিহীনতা শুধু প্রযুক্তিগত অসুবিধা ছিল না, এটি ছিল একটি রাজনৈতিক কৌশল। জনগণের চোখ ঢেকে দেওয়া, বাস্তবতাকে অস্পষ্ট করে রাখা – যেন কেউ প্রশ্ন না করতে পারে।
১৮ জুলাইয়ের আন্দোলনে যে শত শত তরুণ রাস্তায় এসেছিল, তারা চেয়েছিল একটি প্রশ্নের উত্তর – “কেন কোটা সংস্কার করা হবে না?” কিন্তু তারা পেয়েছে পুলিশের রণমূর্তি, রাষ্ট্রের দমননীতি, আর ইন্টারনেটের নীরবতা।
সেদিন শুধুমাত্র শিক্ষার্থীরাই আক্রান্ত হয়নি। সাধারণ মানুষ, পথচারী, এমনকি প্রতিবাদকারীদের পাশে দাঁড়ানো নারী ও শিশুরাও আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। হাসপাতালগুলো ছিল উপচে পড়া আহতদের ভিড়ে।
কিন্তু খবর পৌঁছায়নি। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম পর্যন্ত তখন বিভ্রান্ত ছিল – ইন্টারনেট না থাকায় তাদের প্রতিনিধিরা নিশ্চিত হতে পারছিল না কোনটা গুজব, কোনটা সত্যি।
এই ঘটনার পরে আবার শুরু হয় সরকারের পক্ষ থেকে “উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড”, “বিদেশি চক্রান্ত”, “রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র” ইত্যাদি ভাষ্য। অথচ স্পষ্ট ছিল – রাষ্ট্র তার নাগরিকদের স্বাভাবিক তথ্যপ্রবাহ থেকেও বঞ্চিত করেছে।
প্রাণ বাঁচিয়ে আমি যখন বাসায় ফিরি, মনে হচ্ছিল আমি যেন যুদ্ধফেরত। শরীরে ব্যথা, মনে ভয়, আর চোখে সেই দৃশ্য – আগুন, রক্ত, চিৎকার। একটি স্বাধীন দেশে, একজন নারী সাংবাদিক হিসেবে, কেমন করে এমন অসম্মান, আঘাত, আতঙ্ক সহ্য করতে হয়, আমি তা জানলাম ১৮ জুলাই ২০২৪ সালে।
আজও শরীরের সেই আঘাতের চিহ্ন আছে। কিন্তু তার চেয়ে বেশি গভীর হয়ে আছে এক ধরনের বেদনা – আমাদের প্রতিবাদ, আমাদের প্রশ্ন, আমাদের রক্ত – কোনো কিছুই যেন সেদিন পৌঁছাতে পারেনি গণতন্ত্রের দরজায়। কারণ দরজাই ছিল বন্ধ – ইন্টারনেটের মতোই।