টালমাটাল বিশ্বরাজনীতি : পতনের ঝড়ে নেতৃত্বের আসন

বিশ্বরাজনীতির আকাশে যেন বইছে অস্থিরতার ঝড়। যে আসন একসময় স্থিতিশীলতা ও দূরদর্শী নেতৃত্বের প্রতীক বলে মনে করা হতো—প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে—আজ সেখানে বইছে অনিশ্চয়তার হাওয়া। মাত্র পনের দিনের ব্যবধানে একে একে পদত্যাগ করেছেন নেপাল, ফ্রান্স, জাপান ও থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী। এই সমসাময়িক পতনের ধারা কেবল দেশীয় সংকটের প্রতিফলন নয়; বরং বৈশ্বিক রাজনীতির এক গভীর রূপান্তরের ইঙ্গিত।
নেপালে সরকারের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নজরদারি ও ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত তরুণ প্রজন্মের ক্ষোভকে রূপ দেয় তীব্র বিক্ষোভে। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ মুহূর্তেই পরিণত হয় জনঅভ্যুত্থানে, যার চাপে প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি বিদায় নিতে বাধ্য হন। ফ্রান্সে একই সময়ে আস্থা ভোটে হেরে প্রধানমন্ত্রী ফ্রাসোয়া বাইরু পদত্যাগ করলে ইউরোপীয় রাজনীতির হৃদয়ভূমিতেও নেমে আসে অনিশ্চয়তার ছায়া।
এর কিছুদিন আগেই জাপানে প্রধানমন্ত্রীর আসনে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে। মাত্র ১১ মাস ক্ষমতায় থাকার পর দলীয় বিভাজন ও সংসদীয় সমর্থন হারিয়ে শিগেরু ইশিবার পদত্যাগে উন্মোচিত হয় অচেনা অস্থিরতার দুয়ার। অন্যদিকে থাইল্যান্ডে প্রধানমন্ত্রী পেতুংতার্ন সিনাওয়াত্রা আদালতের রায়ে নৈতিকতা লঙ্ঘনের দায়ে বিদায় নেন; ক্ষমতায় থাকার এক বছরও পূর্ণ হলো না তার।
এই ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখা যাবে না। চার দেশের নেতৃত্বের এ একযোগে পতন আজকের বিশ্বকে স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে—জনগণের সহনশীলতার সীমা সংকুচিত হচ্ছে, আর রাজনীতির পুরনো ধ্যানধারণা দিয়ে নতুন প্রজন্মকে আর নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। বিশেষত জেনারেশন-জি (Gen Z) রাজনীতির অঙ্গনে প্রবেশ করেছে এক অনমনীয় শক্তি হয়ে। তারা জানে কাকে নেতৃত্বে বসাতে হবে, আর কাকে সরে যেতে হবে। দুর্নীতি, অনিয়ম কিংবা ক্ষমতার অহংকারের জায়গা এই প্রজন্ম তাদের অভিধানে রাখে না।
প্রশ্ন এখন একটাই—এই পতনের ধারা কি সাময়িক, নাকি বিশ্বরাজনীতির এক বৃহত্তর পরিবর্তনের সূচনা? চারটি ভিন্ন প্রেক্ষাপটে নেতাদের বিদায় কেবল তাদের ব্যক্তিগত ব্যর্থতা নয়, বরং গণআকাঙ্ক্ষার নতুন মানদণ্ড। এই মানদণ্ডে স্থিতিশীলতা আর নেতৃত্বের প্রতীক হয়ে উঠবে কেবল সেই রাজনীতিক, যিনি জনগণের কণ্ঠস্বর শুনতে জানেন, তরুণ প্রজন্মের দাবি উপলব্ধি করতে জানেন এবং ক্ষমতাকে দেখেন দায়িত্ব হিসেবে, অধিকার হিসেবে নয়।
আজকের বিশ্ব তাই এক নতুন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। পতনের ঝড় যদি সতর্কবার্তা হয়, তবে নেতৃত্বের নতুন ভোরই এখন সময়ের দাবি।