জুলাই সনদ নিয়ে সমঝোতায় আসতেই হবে : প্রধান উপদেষ্টা

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। যে সমঝোতার পথে যাত্রা শুরু হয়েছে, সেখান থেকেই নতুন বাংলাদেশের সূচনা করতে হবে।
রোববার (১৪ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের তৃতীয় ধাপের সংলাপের দ্বিতীয় দিনে তিনি এ মন্তব্য করেন।
ড. ইউনূস বলেন, “জুলাই সনদ থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই। যে সমঝোতার রাস্তা শুরু করেছি, তা থেকে বের হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ সমঝোতায় আসতেই হবে। আমি হয়তো গায়ের জোরে বলছি, কিন্তু কথাটা ফেলে দেওয়ার উপায় নেই। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান আমাদের নবযাত্রার সুযোগ দিয়েছে। এর একমাত্র সমাধান সমঝোতার পথে গিয়ে নতুন বাংলাদেশ তৈরি করা।”
তিনি আরও বলেন, “নানান যুক্তি থাকতে পারে, কিন্তু সমাধানের পথে থাকতে হবে। অনেকের মনে কষ্ট হতে পারে, কিন্তু পরে শান্তি আসবে, দেশ শান্তি পাবে। দেশের শান্তিই বড় শান্তি। বিতর্কের মধ্যে থেকে গেলে সেটি যে কোনো সময় বিস্ফোরিত হতে পারে।”
প্রধান উপদেষ্টা জানান, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে রাজনীতিবিদদের দেওয়া বক্তব্য তিনি টেলিভিশনের মাধ্যমে দেখেছেন এবং কমিশন গঠনের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। শুরুতে তিনি নিশ্চিত ছিলেন না এ প্রক্রিয়া টিকবে কি না, তবে সময়ের সঙ্গে তা দৃঢ় হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ড. ইউনূস আশা প্রকাশ করেন, ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রম বিশ্বব্যাপী এক দৃষ্টান্ত হয়ে উঠবে —“এটি যেন খুতোয়ালা নজির না হয়, বরং এমন নজির হোক যা সারাবিশ্ব দেখবে ও অনুসরণ করবে। আপনারা মূল কাজটি সম্পন্ন করেছেন, এখন সামান্য পথ বাকি।”
তিনি রাজনীতিবিদদের উদ্দেশে বলেন, “আপনারা দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছেন। বাকি রাস্তাটুকু সুন্দরভাবে সমাপ্ত করলে এটি হবে পৃথিবীর জন্য এক অনন্য নজির। দুই দিন আগে নেপালেও একই ধরনের উদ্যোগ শুরু হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও অনেক দেশ এ ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হবে এবং আমাদের সমাধান পদ্ধতি অনুসরণ করবে।”
আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনকে তিনি ‘মহোৎসবের নির্বাচন’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, “নির্বাচন যদি আমরা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারি, তাহলে তা হবে জাতির সত্যিকারের নবজন্ম। এত ত্যাগ-আত্মত্যাগ তখনই স্বার্থক হবে।”
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান প্রসঙ্গে ড. ইউনূস বলেন, “গণঅভ্যুত্থান আলাদিনের চেরাগের দৈত্য তুলে দিয়েছে আমাদের হাতে। আমরা কি তার কাছে এককাপ চা চাইব, না দুনিয়া পাল্টে ফেলতে চাইব — সেটি আমাদের ঠিক করতে হবে। ছোটখাট বিষয়ে না জড়িয়ে, বড় লক্ষ্য নিয়েই এগোতে হবে।”
সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “স্বৈরাচার আসার সব পথ বন্ধ করতে হবে। স্বৈরাচার ঠেকাতে হলে সবাইকে একমত হয়ে কাজ করতে হবে। দ্বিমতের সুযোগ নেই, দ্বিমত করলে আমরা সফল হতে পারব না। তাই সবাইকে একমত হয়ে সনদ বাস্তবায়নে কাজ করতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “যতই আমরা খুঁটিনাটি পরিকল্পনা করি না কেন, ঐক্যই সবচেয়ে বড় শক্তি। কি করতে চাই তা ঠিক করলেই, কিভাবে করব তা বিশেষজ্ঞরা ঠিক করে দেবে। এই দৈত্যকে (অভ্যুত্থানের সুযোগকে) বড় কাজের দায়িত্ব দিতে হবে—যা আর কখনো চাওয়ার সুযোগও মিলবে না।”
ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা হাইওয়ে বানিয়ে ফেলেছি, এই পথেই যেতে হবে। ফেব্রুয়ারির মধ্যে কাজটা শেষ করতে পারলে আমাদের দেশ নিশ্চিন্ত হবে এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশ আমাদের কাছ থেকে শিখতে আসবে।”
ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রম নিখুঁত ও নির্দোষভাবে শেষ করার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “এ কাজ যেন এমনভাবে হয়, যাতে তা থেকে একটি নতুন জাতি জন্ম নিতে পারে। আপনারা নতুন জাতির সূতিকাগার তৈরি করে দিয়েছেন।”
কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (জাতীয় ঐকমত্য কমিশন) মনির হায়দারের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এই সংলাপে বক্তব্য দেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ এবং এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন।