সংস্কার ও শোকের বছর: বিদায় ২০২৫, অগ্নিপরীক্ষার পথে বাংলাদেশ
সময় থেমে থাকে না। ঘড়ির কাঁটা মধ্যরাত ছুঁতেই বিদায় নিয়েছে আরেকটি ঘটনাবহুল বছর। ইতিহাসের পাতায় যুক্ত হয়েছে ২০২৫—একটি বছর, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে রেখে গেছে গভীর ছাপ। নতুন সূর্যের আলোয় শুরু হলো ২০২৬, কিন্তু সামনে অপেক্ষা করছে কঠিন বাস্তবতা ও বড় অগ্নিপরীক্ষা—ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
২০২৫ সাল ছিল সংস্কার, সংঘাত, শোক ও প্রত্যাবর্তনের বছর। মাসে মাসে পাল্টেছে দৃশ্যপট। কোথাও আশার আলো, কোথাও অনিশ্চয়তার ছায়া। চলুন ভিন্ন আঙ্গিকে ফিরে দেখি বিদায়ী বছরের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহ।
জানুয়ারি | সংস্কারের ঘোষণা, রাজনীতির নতুন মোড়
বছরের শুরুতেই রাষ্ট্র সংস্কারের বার্তা দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ১৭ জানুয়ারি জাতির উদ্দেশে ভাষণে তিনি ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। পুলিশ, বিচার বিভাগ ও নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কারে গঠিত কমিশনগুলো মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু করে।
এই মাসেই আসে দুটি আলোচিত ঘটনা। ১৫ জানুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বেগম খালেদা জিয়ার সাজা বাতিল করেন উচ্চ আদালত। পরদিন দীর্ঘ সাড়ে ১৭ বছর পর কারামুক্ত হন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর।
একই সময়ে সাত কলেজকে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে রাজধানীর ক্যাম্পাস ও রাজপথ। মাসের শেষে রেলওয়ের রানিং স্টাফদের ধর্মঘটে কার্যত অচল হয়ে পড়ে রেল যোগাযোগ।
ফেব্রুয়ারি | অভিযান, কূটনীতি ও নতুন রাজনৈতিক শক্তি
অপরাধ দমনে ৮ ফেব্রুয়ারি শুরু হয় যৌথ বাহিনীর বিশেষ অভিযান ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’। প্রথম দিনেই দেশজুড়ে ব্যাপক গ্রেপ্তার জনমনে আলোড়ন তোলে।
কূটনৈতিক অঙ্গনেও ছিল উত্তেজনা। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য ও তৎপরতাকে কেন্দ্র করে ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব করা হয়। ১২ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘ প্রকাশ করে জুলাই অভ্যুত্থান ঘিরে মানবতাবিরোধী অপরাধের আলামত সংবলিত প্রতিবেদন।
মাসের শেষ দিকে রাজনীতির মঞ্চে নতুন সংযোজন ঘটে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম থেকে আত্মপ্রকাশ করে ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’।
মার্চ–এপ্রিল | দ্রব্যমূল্য, আইন সংস্কার ও কূটনৈতিক উষ্ণতা
রমজানকে সামনে রেখে লাগামছাড়া দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খায় সরকার। এ সময় আদানি গ্রুপসহ বিতর্কিত বিদ্যুৎ চুক্তি পর্যালোচনায় উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠিত হয়।
আইন সংস্কারের অংশ হিসেবে বাতিল করা হয় সমালোচিত সাইবার নিরাপত্তা আইন। এর পরিবর্তে জারি হয় ‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫’।
এপ্রিল মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিটে অংশ নেন ৫০টি দেশের প্রতিনিধিরা। পাশাপাশি দীর্ঘ ১৫ বছরের দূরত্ব কাটিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে শুরু হয় উচ্চপর্যায়ের আনুষ্ঠানিক আলোচনা।
মে | নিষেধাজ্ঞা, প্রত্যাবর্তন ও দুর্যোগ
১২ মে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে জুলাই–আগস্ট গণহত্যার বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ এবং দলটির নিবন্ধন স্থগিত করা হয়।
রাজনীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে ৬ মে। দীর্ঘ চিকিৎসা শেষে লন্ডন থেকে দেশে ফেরেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।
একই মাসে বিভিন্ন স্থানে গণপিটুনির ঘটনা উদ্বেগ বাড়ায়। মাসের শেষ দিকে ঘূর্ণিঝড় ও ভূমিধসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নেমে আসে মানবিক বিপর্যয়।
জুন–জুলাই | বাজেটের হিসাব, শোকের ছায়া
২ জুন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার জাতীয় বাজেট উপস্থাপন করেন। উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি থাকলেও মূল্যস্ফীতির চাপ ছিল বড় চ্যালেঞ্জ।
জুলাই মাস জাতিকে দেয় গভীর শোক। ঢাকার উত্তরায় মাইলস্টোন কলেজের ওপর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে প্রাণ হারান ৩২ জন। একই মাসে গ্রেপ্তার হন সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক।
আগস্ট–সেপ্টেম্বর | অভ্যুত্থানের স্মরণ
৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হয় ‘জুলাই বিপ্লব দিবস’। নানা কর্মসূচিতে স্মরণ করা হয় আন্দোলনের শহীদদের।
অক্টোবর–নভেম্বর | রায়, সংস্কার ও অগ্নিকাণ্ড
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জুলাই হত্যাকাণ্ডের দায়ে (অনুপস্থিতিতে) সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। একই সময়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সংবিধানে পুনর্বহাল হয় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা।
নভেম্বরে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকে বিমান চলাচল।
ডিসেম্বর | নির্বাচন, প্রত্যাবর্তন ও শোকাবহ বিদায়
১১ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে। ভোটের দিন নির্ধারিত হয় ২০২৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি।
ডিসেম্বরে দেশ কাঁপায় তরুণ নেতা ওসমান হাদি হত্যাকাণ্ড। ১৮ ডিসেম্বর তার শাহাদাত জাতিকে স্তব্ধ করে দেয়।
২৫ ডিসেম্বর দীর্ঘ ১৭ বছরের নির্বাসন শেষে দেশে ফেরেন তারেক রহমান। তবে বছরের শেষ প্রান্তিকে আসে সবচেয়ে বেদনাদায়ক সংবাদ। দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ইন্তেকাল করেন। ৩১ ডিসেম্বর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে লাখো মানুষের অংশগ্রহণে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয় এবং শহীদ জিয়ার কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়।
২০২৬ | সামনে অগ্নিপরীক্ষা
বিদায়ী বছরের ভার নিয়ে ২০২৬ সালে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন আয়োজন। এর পাশাপাশি রাজনৈতিক ঐকমত্য রক্ষা, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ এবং সাধারণ মানুষের নাগালে দ্রব্যমূল্য রাখা হবে সরকারের জন্য কঠিন পরীক্ষা।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, নির্বাচনের দিনই জুলাই চার্টার বা জুলাই ঘোষণার ভিত্তিতে সংবিধানের মৌলিক সংস্কার নিয়ে গণভোট আয়োজনের প্রস্তুতি রয়েছে। দ্বিকক্ষ সংসদ, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমাবদ্ধতাসহ প্রস্তাবিত পরিবর্তন বাস্তবায়ন নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতার বড় পরীক্ষা হয়ে দাঁড়াবে।



























