ডিগ্রি শুধু কাগজ নয়, মা-বাবার ভালোবাসায় আঁকা এক ক্যানভাস
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) মূল ফটক পেরোলেই চোখে পড়ে তারুণ্যের হাসি, উচ্ছ্বাস আর স্বপ্নের স্রোত। শত শত শিক্ষার্থী প্রবেশ করে এই ক্যাম্পাসে ভবিষ্যতের নতুন অধ্যায় রচনার উদ্দেশ্যে।
কিন্তু এই স্বপ্নযাত্রার পেছনে অদৃশ্যভাবে দাঁড়িয়ে থাকে একটি শক্তিশালী প্রহরী দেয়াল, সেটি হলো মা-বাবার ত্যাগ, প্রার্থনা ও নিরন্তর ভালোবাসা।
যখন কোনো শিক্ষার্থী গ্রাম ছেড়ে প্রথমবার বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে, তখন পরিবারের জন্য তা শুধু একটি বিদায় নয়-এক গভীর মানসিক শূন্যতা।
সন্তান নতুন জীবনে মানিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, কিন্তু দূরের গ্রামে মা-বাবার দিন কাটতে থাকে দোয়া, অস্থিরতা ও অপেক্ষার ছায়ায়। তারা সেই বটবৃক্ষ যারা নিজেরা রোদে পুড়ে সন্তানদের দেন শীতল ছায়া।
গাইবান্ধা থেকে যবিপ্রবিতে পড়তে আসা মা-বাবার কথা স্মৃতিচারণ করে ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন বায়োসায়েন্স বিভাগের ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী সাগর বলেন, প্রতিবার ক্যাম্পাসে ফেরার সময় মা আমাকে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দেন। সংসার থেকে সামান্য বাঁচানো টাকা, বরফে রাখা মাংস, আমার প্রিয় খাবার-সব ব্যাগে ভরে দেন। যশোরে এসে ব্যাগ খুললেই মনে পড়ে যায় মায়ের কান্নাভেজা মুখ আর বাবার পরিশ্রমে ভেজা ঘাম। আমি কখনো পেছনে ফিরে তাকাই না-ভয় হয়, তাদের স্বপ্ন আমি রাখতে পারব তো?
মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সাদিয়া হাসান রিমি বিশ্ববিদ্যালয়ে মা-বাবাকে ছেড়ে কেমন লাগে অনুভূতি জানিয়ে বলেন, আমি কখনো একা কোথাও থাকিনি। হঠাৎ নতুন শহরে এসে বুঝলাম-জীবন সহজ না। প্রতিদিন মা ফোনে বলেন, 'ঠিক মতো খেও, নিজের যত্ন নিও। অসুস্থ হলে বলতে ইচ্ছে করে না, জানি তারা ভয় পেয়ে যাবে। ক্লাস, ল্যাব, পরীক্ষার চাপে যখন মন ভেঙে যায়, তখনই বাবার কথা মনে পড়ে।”
ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সুমাইয়া ইয়াসমিন ফারহা বলেন, ছুটি শেষে ক্যাম্পাসে ফেরার সময় মনে হয় এখনই যেন তাদের আমার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। আরও দুদিন পাশে থাকতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে-তারা আমাকে নিয়ে যে স্বপ্ন বুনছেন, তা পূরণ করাটা আমার দায়িত্ব। দূরে থাকলেও তাদের হাসিই আমার শক্তি।
ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন বায়োসায়েন্স বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মা-বাবা ছাড়া অসহায়ত্বের কথা জানিয়ে রাজু আহম্মেদ বলেন, আমরা দুই ভাই-আমি ছোট। বড় ভাই চাকরি করেন দশ বছর ধরে, তিন মাসে একবার বাড়ি আসেন। আমি চার বছর ধরে পড়াশোনার জন্য বাড়ির বাইরে। এখন বাড়িতে থাকেন শুধু বাবা-মা। আমাদের জন্য চিন্তা করতে করতে তারা ধীরে ধীরে যেন দুর্বল হয়ে যাচ্ছেন। অনেক দিন পর বাড়ি গেলে দেখি-তারা আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছেন। তাদের হাসি দেখে আমার মনও শান্তিতে ভরে যায়। কিন্তু ক্যাম্পাসে ফেরার সময় বাবা-মা দরজায় দাঁড়িয়ে থাকেন। চোখে শুধু অপেক্ষার প্রশ্ন—'কবে আবার ফিরবে? শেষ কথা, আমি বাবা-মাকে খুব ভালোবাসি। তাদের ছাড়া আমি সত্যিই অসহায়।
ভর্তি ফি, হলে থাকা, মেস খরচ, বই, ল্যাব-প্রতিটি বিষয়ই সাধারণ পরিবারের জন্য চ্যালেঞ্জ। তবুও বাবা-মা থেমে যান না। তাদের বিশ্বাস-সন্তানের ছোট্ট অগ্রগতিই তাদের সব পরিশ্রমের প্রতিদান।যবিপ্রবিতে ঘুরতে আসা একজন শিক্ষার্থীর বাবা কণ্ঠ ভারী করে বলেন,"আমার আর কোনো শখ নেই। শুধু সন্তানের নামে একটা ডিগ্রি দেখতে চাই। নিজেরা পুরনো লুঙ্গি পরলাম, তাতে কী-ও মানুষ হোক, এটাই চাই।"
সন্তানের প্রতিটি সফলতা, প্রতিটি হাসির পেছনে লুকিয়ে আছে মা-বাবার অগণিত দোয়া, শ্রম আর ত্যাগ। তাই প্রতিটি ডিগ্রি আসলে শুধু অর্জন নয়—এটি মা-বাবার ভালোবাসার তুলিতে আঁকা একটি রঙিন স্বপ্নপথ। তথা মা-বাবার ভালোবাসায় আঁকা এক ক্যানভাস।



























