বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ’একাত্তরের ভূত’
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বর্তমানে এক অদ্ভুত ও বিপজ্জনক দ্বিচারিতা প্রকট হচ্ছে। একদিকে ইসলামী ছাত্রশিবির নিজেদেরকে 'স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া সংগঠন' হিসেবে দাবি করে, নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি সেজে দেশপ্রেমের ঢোল বাজাচ্ছে। তারা প্রচার করছে, তারা বাংলাদেশের পক্ষের শক্তি, জামায়াতে ইসলামীর অতীতের দায় তারা বহন করবে না। কিন্তু তাদের কার্যকলাপে বারবার প্রমাণ হচ্ছে—এই 'বাংলাদেশপ্রেম' কেবলই একটি মোড়ক, যার আড়ালে লুকিয়ে আছে একাত্তরের পরাজিত শক্তির বিষাক্ত আদর্শিক ভিত্তি।
শিবিরের দ্বিচারিতা প্রমাণের জন্য ইতিহাসের গভীরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুকে, শহীদের রক্তে ভেজা মাটিতে, তাদের একটি প্রদর্শনীতে যুদ্ধাপরাধীদের 'বীর' বা 'শহীদ' হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে দণ্ডিত, বাংলাদেশের জন্মের বিরোধিতা করায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের এভাবে মহিমান্বিত করা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি সরাসরি অবমাননা। যারা বাংলাদেশের অস্তিত্বকে অস্বীকার করেছিল, তাদেরই ‘দেশপ্রেমের প্রতিনিধি’ হিসেবে প্রচার করা—এটি নতুন প্রজন্মের সামনে ইতিহাস বিকৃতির এক চরম উদাহরণ। এটি স্পষ্ট করে যে, 'নতুন প্রজন্ম' বা 'বাংলাদেশের পক্ষের শক্তি' হওয়ার দাবিটি তাদের রাজনৈতিক কৌশল মাত্র, আদর্শিক অবস্থান নয়।
যখন জামায়াতে ইসলামী কৌশলগত কারণে 'নাটকীয় ক্ষমা প্রার্থনা'র পথে হাঁটে, ঠিক সেই মুহূর্তে তাদের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির তাদের অফিসিয়াল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কুখ্যাত রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধে সাজাপ্রাপ্ত গোলাম আযমকে 'জাতীয় বীর' বা 'গুরু' হিসেবে তুলে ধরে। জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে তাকে 'বিশ্বনন্দিত ইসলামী চিন্তাবিদ, ভাষা আন্দোলনের নেতা, ডাকসুর সাবেক জিএস, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপকার' ইত্যাদি নানা বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে। প্রশ্ন জাগে—এ কেমন ক্ষমা? যে আদর্শের কারণে একাত্তরে লাখো মানুষের রক্ত ঝরেছে, সেই আদর্শের প্রধান গুরুকে যারা 'বীর' হিসেবে প্রচার করে, তাদের 'অনুতাপ' বা 'ক্ষমা প্রার্থনা' কি জনমানসে বিভ্রান্তি ছড়ানোর একটি নতুন চাল নয়?
শিবির এই বক্তব্যের মাধ্যমে মূলত তাদের মূল আদর্শিক ভিত্তি থেকে একচুলও সরে না আসার বার্তা দিয়েছে। তাদের কাছে, একাত্তরের পরাজিত শক্তিই হলো 'আদর্শিক নেতা'। প্রকাশ্যে নমনীয়তা দেখালেও, সংগঠনের মূল কাঠামো এবং আদর্শিক ভিত্তি এখনও সেই পাকিস্তানপন্থী চিন্তাধারার ওপরই প্রতিষ্ঠিত।
শিবির ও জামায়াত খুব ভালো করেই জানে, 'বাংলাদেশবিরোধী' তকমা এখন এদেশের তরুণ সমাজ এবং সাধারণ জনগণের কাছে ঘৃণা ও প্রত্যাখ্যানের প্রতীক। তাই প্রকাশ্যে তারা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে, দেশীয় পোশাক পরে, শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের কথা বলে 'বাংলাদেশপন্থী' সাজার অভিনয় করছে। কিন্তু যখনই তাদের সুযোগ আসে, তখনই তাদের ভেতরের '৭১-এর বিষবীজ' বেরিয়ে আসে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে। এটি কেবল একটি 'দুইমুখো' অবস্থান নয়, এটি হলো তাদের রাজনৈতিক টিকে থাকার কৌশল এবং আদর্শিক দৃঢ়তার এক চরম দ্বন্দ্ব।
বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে এই প্রতারণার রাজনীতি থেকে সতর্ক থাকতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ কেবল একটি ইতিহাস নয়, এটি একটি বিশ্বাস, একটি আদর্শিক ভিত্তি। যে সংগঠন একদিকে যুদ্ধাপরাধীদের বীর বানায়, আর অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রতি দায়বদ্ধতার অভিনয় করে—তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা কেবল মুখে নয়, ইতিহাসে হারিয়ে যায়। স্বাধীনতার নামে যারা আজও স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, যারা নিজেদের নেতাদের মহিমান্বিত করতে গিয়ে লাখো শহীদের আত্মত্যাগ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অবমাননা করে, তারা যতই নিজেদের সাজাক, বাংলাদেশের ভবিষ্যত প্রজন্ম তাদের প্রকৃত পরিচয় চিনে নেবে। ইতিহাস তাদের চিরকাল পরাজিত শক্তি হিসেবেই মনে রাখবে। এই আদর্শিক প্রতারণার বিরুদ্ধে সচেতনতাই হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি প্রকৃত সম্মান।



























