২০২৬ সালে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম হবে ছয় বছরে সর্বনিম্ন: বিশ্বব্যাংক
বিশ্বব্যাংক গ্রুপের সর্বশেষ কমোডিটি মার্কেটস আউটলুক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৬ সালে বৈশ্বিক পণ্যমূল্য ছয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসবে। এটি টানা চতুর্থ বছরের মতো দাম কমার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুর্বল বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান তেলের উদ্বৃত্ত এবং নীতিগত অনিশ্চয়তার কারণে ২০২৫ ও ২০২৬ সালে গড়ে ৭ শতাংশ করে পণ্যমূল্য হ্রাস পেতে পারে।
জ্বালানির দাম কমে আসায় বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা প্রশমিত হয়েছে এবং চাল ও গমের দাম কমায় অনেক উন্নয়নশীল দেশে খাদ্য আরও সাশ্রয়ী হয়েছে। তবে দাম এখনো মহামারি-পূর্ব সময়ের তুলনায় বেশি—২০২৫ সালে ২৩ শতাংশ ও ২০২৬ সালে ১৪ শতাংশ বেশি থাকবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিশ্বব্যাংক জানায়, ২০২৫ সালে বৈশ্বিক তেল উদ্বৃত্ত উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে এবং ২০২৬ সালে তা ২০২০ সালের উচ্চমাত্রার তুলনায় ৬৫ শতাংশ বেশি হতে পারে। বৈদ্যুতিক ও হাইব্রিড গাড়ির ব্যবহার বৃদ্ধির পাশাপাশি চীনে তেল ব্যবহারের স্থবিরতাও এই প্রবণতায় ভূমিকা রাখছে।
ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের গড় দাম ২০২৫ সালে ব্যারেলপ্রতি ৬৮ ডলার থেকে কমে ২০২৬ সালে ৬০ ডলারে নামবে—যা পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। সামগ্রিকভাবে জ্বালানির দাম ২০২৫ সালে ১২ শতাংশ এবং ২০২৬ সালে আরও ১০ শতাংশ কমবে বলে পূর্বাভাসে উল্লেখ রয়েছে।
খাদ্যদ্রব্যের দামও কমছে। ২০২৫ সালে ৬.১ শতাংশ এবং ২০২৬ সালে ০.৩ শতাংশ হ্রাসের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদন ও বাণিজ্যিক টানাপোড়েনের কারণে সয়াবিনের দাম কমলেও তা পরবর্তী দুই বছরে স্থিতিশীল থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার কারণে সারের দাম ২০২৫ সালে ২১ শতাংশ বাড়বে, যদিও ২০২৬ সালে তা ৫ শতাংশ কমবে।
নিরাপদ বিনিয়োগের চাহিদা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর স্বর্ণ ক্রয় বৃদ্ধির কারণে মূল্যবান ধাতুর বাজার ঊর্ধ্বমুখী।
স্বর্ণের দাম ২০২৫ সালে ৪২ শতাংশ এবং ২০২৬ সালে আরও ৫ শতাংশ বাড়বে বলে পূর্বাভাসে বলা হয়েছে। একই সময়ে রুপার দাম ৩৪ শতাংশ ও ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে।
বিশ্বব্যাংক সতর্ক করেছে, বাণিজ্যিক টানাপোড়েন ও নীতিগত অনিশ্চয়তা অব্যাহত থাকলে পণ্যমূল্য পূর্বাভাসের চেয়ে আরও নিচে নেমে যেতে পারে। ওপেক প্লাস দেশগুলো প্রত্যাশার চেয়ে বেশি তেল উৎপাদন করলে উদ্বৃত্ত আরও বাড়বে, যা দামের ওপর বাড়তি চাপ ফেলবে।
অন্যদিকে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, সংঘাত বা নতুন নিষেধাজ্ঞা তেলের দাম বাড়াতে পারে এবং স্বর্ণ ও রুপার মতো নিরাপদ সম্পদের চাহিদা বাড়াবে।
একই সঙ্গে প্রবল লা নিনিয়া চক্রের কারণে চরম আবহাওয়া কৃষি উৎপাদন ব্যাহত করতে পারে এবং গরম-ঠান্ডা সামলাতে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়াতে পারে; যা খাদ্য ও জ্বালানির দামে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করবে।
অন্যদিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) দ্রুত সম্প্রসারণ এবং ডেটা সেন্টার পরিচালনার জন্য বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় শক্তি ও বেস মেটাল যেমন অ্যালুমিনিয়াম ও তামার দামও বাড়তে পারে, যেগুলো এআই অবকাঠামোর জন্য অত্যাবশ্যক।
বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ইন্দরমিত গিল বলেন, “জ্বালানির দাম কমে আসায় মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস পেয়েছে, তবে এই স্বস্তি স্থায়ী নয়। সরকারগুলোর এখনই রাজস্ব সংস্কার ও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলার সুযোগ কাজে লাগানো উচিত।”
সংস্থার ডেপুটি চিফ ইকোনমিস্ট আয়হান কোসে যোগ করেন, “তেলের দাম কমে যাওয়া উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য রাজস্ব সংস্কার ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করেছে। ব্যয়বহুল জ্বালানি ভর্তুকি ধীরে ধীরে কমিয়ে অবকাঠামো ও মানবসম্পদে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।”
প্রতিবেদনের বিশেষ আলোচ্য অংশে বলা হয়েছে, অতীতে উৎপাদন কোটার সীমা, মজুত নিয়ন্ত্রণ ও বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা স্বল্পমেয়াদে কিছু স্থিতিশীলতা আনলেও দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর হয়নি।
তাই বিশ্বব্যাংক দেশগুলোকে আহ্বান জানিয়েছে— “মূল্য নিয়ন্ত্রণের বদলে উৎপাদন বৈচিত্র্য, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ, তথ্যের স্বচ্ছতা বৃদ্ধি এবং বাজারভিত্তিক মূল্য নির্ধারণ ব্যবস্থার মাধ্যমে টেকসই স্থিতিশীলতা গড়ে তুলতে হবে।”



























