বুধবার ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৬ অগ্রাহায়ণ ১৪৩২

মারিয়া সালাম

প্রকাশিত: ১৩:২৪, ১০ ডিসেম্বর ২০২৫

গরম ভাতে বিলাই বেজার

গরম ভাতে বিলাই বেজার
ছবি: গ্রাফিক্স

বেশ কয়েকদিন আগে আলাপে আলাপে একজন বলল, আজ দেশের যে অবস্থা, এরজন্য একমাত্র দায়ী শেখ মুজিবুর রহমান। এর বিপক্ষে যুক্তি দেয়া শুরু করতে গিয়েও থেমে গেলাম। 

কয়েক সেকেন্ড ভেবে দেখলাম কথা সত্য। ধীরে ধীরে বললাম, আপনার সাথে আলাপের মাধ্যমে বিষয়টা দিনের আলোর মতো পরিস্কার, ফলে আমার কোনও দ্বিমত নাই। একটু দুইলাইনে বুঝিয়ে বলি কেন বঙ্গবন্ধু দায়ী এবং শুধু তিনি নন, তাঁর কন্যা শেখ হাসিনারও দায় এড়ানোর কোন পথ নাই। 

লোকটির চোখে আলোর ঝলক দেখলাম, আনন্দ চিকচিক করছে। আবার প্রশ্ন করলাম, ৭১ এ রাজাকার বাহিনীর আকার কেমন ছিল? সে আমতা আমতা করতে লাগল, মানে সঠিক সংখ্যা সে জানে না। এক্সাক্ট সংখ্যা আমিও জানি না, তবে বইপত্র ঘাটলে সেটা দাঁড়ায় ৩৫-৪০ হাজারের মতো। আরেকটু স্পেসিফিক করে বললে, মূল অভিযুক্ত তখন প্রায় ৩৭ হাজার। 

আমি আবার শুরু করলাম, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের সঙ্গে সঙ্গে রাজাকার বাহিনীর বিলুপ্তি ঘটে। এবার প্রশ্ন হলো এরপর রাজাকারদের পরিণতি কী হলো? বেশ কয়েকজন কুখ্যাত রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে মারা পড়ল। এরপর ১৯৭৩ সালের নভেম্বরে এসে বঙ্গবন্ধু সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন কারণ তিনি মনে করলেন দখলদার বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতার অভিযোগে আটক কিংবা দণ্ডিত সবাই এখন কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনায় দগ্ধ। যেসব ব্যক্তি ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ অথবা পরিকল্পিত হত্যার দায়ে অভিযুক্ত অথবা দণ্ডপ্রাপ্ত; তারা ছাড়া দালাল আইন (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) ১৯৭২ বলে বাকিদের ক্ষমা করে দেয়া হলো। তবে, আইনে ৫নং ধারার (ক) অনুচ্ছেদে যে বিধান রাখা হয় সে মতে , যারা (১) ১২১ (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানো অথবা চালানোর চেষ্টা), (২) ১২১ ক (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর ষড়যন্ত্র), (৩) ১২৮ ক (রাষ্ট্রদ্রোহিতা), (৪) ৩০২ (হত্য), (৫) ৩০৪ (হত্যার চেষ্টা), (৬) ৩৬৩ (অপহরণ), (৭) ৩৬৪ (হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ) (৮) ৩৬৫ (আটক রাখার উদ্দেশ্যে অপহরণ), (৯) ৩৬৮ (অপহৃত ব্যক্তিকে গুম ও আটক রাখা), (১০) ৩৭৬ (ধর্ষণ), (১১) ৩৯২ (দস্যুবৃত্তি), (১২) ৩৯৪ (দস্যুবৃত্তিকালে আঘাত), (১৩) ৩৯৫ (ডাকাতি), (১৪) ৩৯৬ (খুনসহ ডাকাতি), (১৫) ৩৯৭ (হত্যা অথবা মারাত্বক আঘাতসহ দস্যুবৃত্তি অথবা ডাকাতি), (১৬) ৪৩৫ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে ক্ষতিসাধণ), (১৭) ৪৩৬ (বাড়িঘর ধ্বংসের উদ্দেশ্যে আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহার), (১৮) ফৌজদারী দন্ডবিধির ৪৩৬ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে কোন জলযানের ক্ষতি সাধন) অথবা এসব কাজে উৎসাহ দান করেছে তারা কোনভাবেই ক্ষমার যোগ্য নন। তারপরেও সেই ৩৭ হাজারের মধ্যে নব্বইভাগই ক্ষমার আওতায় গিয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন শুরু করল। মক্কা বিজয়ের পর রসুল যেমন কাফেরদের সাধারণ ক্ষমা করেছিলেন, বঙ্গবন্ধু সেই মহৎ ঘটনাকে হয়তো উদাহরণ হিসেবে নিয়েছিলেন বা উনি নিজের দেশের এত মানুষকে শাস্তি দিতে চাননি, সেটা আমার অনুমান। শুধু রাজাকার না, বিজয়ের পর যখন বিভিন্ন অনুসন্ধানে বের হয়ে এসেছিল, পাকি হানাদারদের বিভিন্ন পর্যায়ের সহযোগীদের নাম, সেসবও তিনি আর প্রকাশ করেন নি। কিন্তু তাঁর এই অনুকম্পার প্রতিদান হিসেবে এই রাজাকারদের চক্রান্ত চলতেই থাকল এবং পচাত্তরের বিপর্যয় নেমে আসল। এটার জন্য বঙ্গবন্ধুকে শুরু থেকেই একটা দায় দেয়া যায়। 

আমার কথা লোকটির পছন্দ হলো না বুঝতে পারলাম। সে আর আলাপে আগ্রহী না। বলল, থাক বাদ দেন, আমার একটা কাজ আছে, আজ উঠি।

আমি প্রায় টেনে ধরে বসালাম তাকে। আরে বাকি অর্ধেক মানে শেখ হাসিনার দায় কোথায় শুনে যান ভাই, বঙ্গবন্ধু এই ষড়যন্ত্র বুঝে উঠার আগেই প্রাণ দিলেন। কিন্তু তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা সে তুলনায় অনেক দেখেছিলেন, সবাইকে হাড়ে হাড়ে চিনতেন। তিনি ক্ষমতায় এসে এই রাজাকারদের চুড়ান্ত তালিকা শেষ করতে পারলেন না। একটা খসড়া তালিকা বের হলো যাতে প্রায় ১১ হাজার নাম ছিল। এটা নিয়েও শুরু হলো মিথ্যাচার, বলা হলো এসব তালিকাভুক্ত রাজাকারের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর ৩৭ জন(২৫ জন মৃত), অন্যান্য দলের ৮৭৯ জন, বিএনপির ১০২৪ জন আর আওয়ামী লীগেরই সবচেয়ে বেশি ৮০৬০ জন।অর্থাৎ, একমাত্র জামায়াতে ইসলামী ছাড়া বাকি সব দলই রাজাকারের দল। খোদ আওয়ামী লীগই সবচেয়ে বড় রাজাকারের দল। এসব সাইবার প্রপাগাণ্ডা ঠেকাতে তৎকালীন সরকার কী ব্যবস্থা নিলেন? তারা কঠিন আইন করলেন আর সেই আইনের প্রয়োগ ঠিকঠাক হলো না উল্টা সরকারের দমন-পীড়নের গল্পটাই মুখ্য হয়ে উঠে এল। সরকার ডিজিটাল কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের কোন ভেরিফায়েড সোস্যাল মিডিয়া হ্যান্ডল নাই, যা দিয়ে মানুষের কাছে সঠিক ব্যাখ্যা তুলে ধরা যায়। সেই ৩০-৪০ হাজার রাজাকার যে এই পঞ্চাশ বছরে ঝাড়ে বংশে কয়েক লক্ষ হয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে বসে ছিল, সেটা নিয়ন্ত্রণ করার কোন কার্যকর ভূমিকা দেখা যায় নি। শেখ হাসিনাও তাঁর পিতার মতো উদারনীতি গ্রহণ করে এই যে সবার জন্য সমান সুবিধা নিশ্চিত করেছিলেন, সেটার জন্য তাকে অবশ্যই আপনি দায় দিতে পারেন।

ভদ্রলোক আরেকটু কাঁচুমাচু করে বললেন, আসলে এসব তর্কের বিষয় না। আমি বললাম, হ্যা আপনার কাছে বিষয়টা বিশ্বাসের, ঈমানের। আপনার ঈমান আমার কাছে একদম ক্লিয়ার। তবে, আমার কাছে বিষয়টা যুক্তির। আজ আপনার তাড়া যেহেতু আছে, আরেকদিন এসেন সময় নিয়ে, যুক্তি আর বিশ্বাসের বিশদ আলাপ দরকার আছে।

জনপ্রিয়