মুক্তিযোদ্ধা–শিল্পীরা: সংস্কৃতির ময়দানে যোদ্ধাদের গল্প
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও বিনোদন অঙ্গন কেবল আলোর ঝলকানি, ক্যামেরা বা অভিনয়ের গল্প নয়—এর গভীরে জড়িয়ে আছে রক্ত, সাহস আর আত্মত্যাগের ইতিহাস। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে এমন অনেক মানুষ অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছিলেন, যারা স্বাধীনতার পর হাতে তুলে নিয়েছেন ক্যামেরা, স্ক্রিপ্ট ও মাইক্রোফোন। তারা শুধু শিল্পী নন—তারা যোদ্ধা, যারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে সংস্কৃতির ময়দানে দেশের আত্মপরিচয় নির্মাণে ভূমিকা রেখেছেন।
স্বাধীনতার পর চলচ্চিত্র, নাটক ও সংগীত হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার শক্তিশালী মাধ্যম। সেই পথচলার অগ্রভাগে ছিলেন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা–শিল্পী, যাদের জীবন ও কর্ম একসঙ্গে ধারণ করে সংগ্রাম আর সৃষ্টির ইতিহাস। এমনই কয়েকজন গুণী মানুষের গল্প তুলে ধরা হলো।
কামরুল আলম খান খসরু
ঢাকা অঞ্চলের গেরিলা বাহিনীর অধিনায়ক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন কামরুল আলম খান খসরু। যুদ্ধের আগে ও পরে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় এই মানুষটি অভিনয় করেন ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’–এ। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র হিসেবে ছবিটি আজও ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
নায়ক ফারুক
আকবর হোসেন পাঠান দুলু—চলচ্চিত্রাঙ্গনে যিনি নায়ক ফারুক নামে পরিচিত। পুরান ঢাকার এই সাহসী তরুণ মুক্তিযুদ্ধের সময় সম্মুখ সমরে অংশ নেন। স্বাধীনতার বছরেই এইচ আকবর পরিচালিত ‘জলছবি’ সিনেমার মাধ্যমে শুরু হয় তার অভিনয়যাত্রা। পরবর্তী সময়ে তিনি ঢালিউডের অন্যতম সফল ও জনপ্রিয় নায়কে পরিণত হন।
সোহেল রানা
মাসুদ পারভেজ, যিনি সোহেল রানা নামে পরিচিত, ছিলেন ১৯৭১ সালের একজন নির্ভীক মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতার পর তিনি প্রযোজনা করেন বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’। ১৯৭৩ সালে ‘মাসুদ রানা’ সিনেমার মাধ্যমে নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে তিনি চলচ্চিত্রে এক নতুন ধারার সূচনা করেন।
জাফর ইকবাল
ঢালিউডের স্মার্ট ও স্টাইলিশ নায়ক জাফর ইকবাল মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলেন। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে নিয়মিত অভিনয়ে যুক্ত হয়ে তিনি আশির দশকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছান। নিজস্ব অভিনয়ভঙ্গি ও ব্যক্তিত্বে তিনি দর্শকের হৃদয়ে স্থায়ী জায়গা করে নেন।
নায়ক জসীম
অ্যাকশন ছবির পথিকৃৎ হিসেবে পরিচিত জসীম কলেজছাত্র থাকাকালীন সেক্টর দুইয়ের অধীনে মেজর এটিএম হায়দারের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে ‘দেবর’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তার অভিনয়জীবনের সূচনা হয়। পরবর্তীতে তিনি অ্যাকশন হিরোর প্রতীক হয়ে ওঠেন।
হুমায়ূন ফরীদি
১৯৭১ সালে পড়াশোনা ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন হুমায়ূন ফরীদি। যুদ্ধশেষে মঞ্চনাটকের মাধ্যমে তার শিল্পীসত্তার বিকাশ ঘটে। পরবর্তীতে টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে তিনি হয়ে ওঠেন এক অনন্য কিংবদন্তি—যার অভিনয়ে বাস্তবতা, শক্তি ও মানবিকতার গভীর ছাপ স্পষ্ট।
আসাদুজ্জামান নূর
‘বাকের ভাই’ চরিত্রে অমর হয়ে থাকা আসাদুজ্জামান নূর মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন সেক্টর ছয়ের অধীনে। মুক্তিযুদ্ধের আগেই থিয়েটারে যুক্ত নূরের টেলিভিশন যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৪ সালে। অভিনয়ের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও তিনি রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
রাইসুল ইসলাম আসাদ
ঢাকার উত্তর বাহিনীর একজন গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে লড়েন রাইসুল ইসলাম আসাদ। যুদ্ধের অভিজ্ঞতা তার অভিনয়ে এনে দেয় আলাদা গভীরতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা। শক্তিমান অভিনেতা হিসেবে তার উপস্থিতি বাংলাদেশের অভিনয়জগতকে করেছে সমৃদ্ধ।
এছাড়াও পপগানের কিংবদন্তি আজম খান, নির্মাতা নাসিরউদ্দিন ইউসূফ বাচ্চুসহ আরও অনেক শিল্পী মুক্তিযুদ্ধে জীবন বাজি রেখে লড়েছেন। তাদের সবার জীবন প্রমাণ করে—বাংলাদেশের সংস্কৃতি কেবল বিনোদন নয়, এটি সংগ্রাম, চেতনা ও স্বাধীনতার এক জীবন্ত দলিল।



























